Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জঙ্গি প্রভাবিত গ্রামে শিশুদের স্বপ্ন দেখালেন পুলিশ সাহেব

ওরা কেউ কোনও দিন ট্রেন দেখেনি। এমনকী সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমাও দেখেনি। দেখেনি খেলার মাঠ, পার্ক। রাঁচি শহর তো দূরের কথা, ওরা দেখেনি ওদের জেলা শহর, সিমডেগাও। ওদের কাছে পৃথিবী বলতে শুধু নিজেদের গ্রাম, জঙ্গল আর জঙ্গি-আতঙ্ক।

শহরে ঘোরার আনন্দে। সিমডেগায় হকির মাঠে। —নিজস্ব চিত্র

শহরে ঘোরার আনন্দে। সিমডেগায় হকির মাঠে। —নিজস্ব চিত্র

আর্যভট্ট খান
রাঁচি শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৬ ১০:২৩
Share: Save:

ওরা কেউ কোনও দিন ট্রেন দেখেনি। এমনকী সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমাও দেখেনি। দেখেনি খেলার মাঠ, পার্ক। রাঁচি শহর তো দূরের কথা, ওরা দেখেনি ওদের জেলা শহর, সিমডেগাও। ওদের কাছে পৃথিবী বলতে শুধু নিজেদের গ্রাম, জঙ্গল আর জঙ্গি-আতঙ্ক। এই জঙ্গল থেকে ওদের একদিনের জন্য বের করে এনে ট্রেন দেখালেন, সিনেমা দেখালেন আর তারপর রেস্তোঁরায় চাইনিজ খাওয়ালেন সিমডেগার পুলিশ সুপার রাজীবরঞ্জন সিনহা। আসলে একটা ‘স্বপ্ন’ দেখালেন।

সিমডেগার জঙ্গলে মাওবাদী গতিবিধির খবর পেয়ে সার্চ অপারেশনে বেরিয়েছিলেন রাজীব রঞ্জন। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে তিনি চলে আসেন বানো ব্লকের জঙ্গল ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রাম, সাহুবেরায়। খবর ছিল ওই গ্রামেই লুকিয়ে আছে কয়েকজন জঙ্গি। গ্রামে সার্চ অপারেশন চলাকালীন রাজীবরঞ্জন ঢুকে পড়েন গ্রামের প্রাথমিক স্কুলটিতে। রাজীবের কথায়, ‘‘সার্চ অপারেশন করে গ্রামে কিছু পাইনি। তখন গ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি জানতে স্কুলের খুদে ছাত্রদের সঙ্গেই আন্তরিক হয়ে গল্প করতে শুরু করি। কিছুক্ষণ কথা বলার পরে বুঝতে পারি ওদের কাছে আমি আর পুলিশ নেই। হয়ে গিয়েছি ওদের অভিভাবকের মতোই কেউ একজন। ওদের নানা কথা শুনতে শুনতে জানতে পারি ওরা কোনও দিন গ্রামের বাইরেই যায়নি। ওদের পৃথিবী বলতে শুধু ওদের গ্রাম আর জঙ্গল। এমনকী ট্রেনও দেখেনি অনেকে।’’ রাজীবের তখনই মনে হয় এই সব দশ বারো বছরের বাচ্চাদের যদি একদিনের জন্য বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করানো যায়, তাহলে কেমন হয়?

যেমন ভাবা তেমন কাজ! পরের দিনই সব ব্যবস্থা পাকা। স্কুলের ৭৫ জন খুদে ছাত্রদের নিয়ে এসপি চলে আসেন গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে, বানো থানায়। সেখানে তৈরি ছিল বাস। সেই বাসে করেই শুরু হয় খুদে ছাত্রদের শহর ভ্রমণ। ৭৫ জন ছাত্রের নিরাপত্তার জন্য ছিল ১৫ জন পুলিশ। প্রথমে বানো রেল স্টেশনে এসে ট্রেন দেখে খুদেরা। ওই খুদেদের সঙ্গে থাকা এক কনস্টেবল বলেন, ‘‘স্টেশনে ট্রেন ঢোকা দেখে ওদের চোখে অপার বিস্ময় ফুটে ওঠে। এতবড় একটা ট্রেন কী ভাবে দুটো লাইনের মধ্যে দিয়ে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন করছিল ওরা।’’ এরপর ওদের নিয়ে যাওয়া হয় সিমডেগার হকি স্টেডিয়ামে। রাজীবরঞ্জন বলেন, ‘‘সিমডেগা হকির জন্য বিখ্যাত। এখান থেকে প্রচুর খেলোয়াড় ভারতীয় হকি দলে খেলেছে। এই সব বাচ্চারাও কেউ কেউ হকি খেলে গ্রামে। কিন্তু স্টেডিয়াম কাকে বলে, কাকে বলে অ্যাস্ট্রোটার্ফ মাঠ তা ওরা জানে না।’’

স্টেডিয়াম শুধু দেখাই নয় সেখানে খেলার অভিজ্ঞতাও হল বাবুলাল, দীনেশ, অনিলদের। কিছুক্ষণ চুটিয়ে হকি খেলার পর ওরা চলে যায় শহরে। ইভনিং শোয়ে সিনেমা দেখে তারা। সিনেমা শেষে রেস্তোঁরায় গিয়ে চাইনিজ ডিনার। খাওয়া দাওয়া শেষে ফের পুলিশই তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় গ্রামে। রাজীব রঞ্জনের কথায়, ‘‘গ্রামের বাচ্চাদের স্রেফ ঘোরানোর জন্যই এই ট্যুরের ব্যবস্থা করিনি। ওরা যে গ্রামে থাকে সেখানে মাওবাদীদের প্রভাব মারাত্মক। পড়াশোনা করে জীবনের মূলস্রোতে প্রবেশ করার আগেই অনেকে মাওবাদীদের খপ্পরে পড়ে যায়।’’ এই পৃথিবী কতটা আধুনিক, কতটা আকর্ষণীয় তা জানাতেই এই সুপার-ট্যুর। পুলিশ সুপারের কথায়, ‘‘ওদের আসলে একটা স্বপ্ন দেখালাম। এর পর বিবেচনা ওদের।’’

খুদে ছাত্ররা অবশ্য বেশি বোঝে না। ওরা ট্রেন দেখতে পেয়েই খুশি। খুব খুশি চিলি চিকেন, চাউমিন আর চিকেন মোমো খেয়ে। ওরা আবার যেতে চায় তাদের জেলা-শহর সিমডেগায়। বাবুলাল তো বলেই ফেলল, ‘‘ভাল করে পড়াশোনা করতে শহরে যাব। আর এ বার শুধু ট্রেন দেখাই নয়, ট্রেনে উঠে সোজা চলে যাব রাঁচি ঘুরতে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Police officer Militants influence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE