Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

‘রাজ্যের সঙ্গে কথা না বলেই নোট বাতিল!’

সাধারণ মানুষের রুজি-রুটিতে থাবা তো বসেইছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পায়েও কুড়ুল মেরেছে নোট বাতিলের একতরফা সিদ্ধান্ত। অথচ নিজেদের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে বিরোধীরা একজোট হয়ে তার তেমন জোরালো প্রতিবাদ করেননি।

—নিজস্ব চিত্র।

—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:০৩
Share: Save:

সাধারণ মানুষের রুজি-রুটিতে থাবা তো বসেইছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পায়েও কুড়ুল মেরেছে নোট বাতিলের একতরফা সিদ্ধান্ত। অথচ নিজেদের মধ্যে মতানৈক্যের কারণে বিরোধীরা একজোট হয়ে তার তেমন জোরালো প্রতিবাদ করেননি। ফলে আগাগোড়া ভুল পদ্ধতিতে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত যে কতখানি গলদে ঠাসা, এখনও তা আঁচ করতে পারেননি আমজনতার বড় অংশ। নোট নাকচ নিয়ে মঙ্গলবার এক টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনই অভিযোগ তুললেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

তাঁর কথায়, ‘‘নোট বাতিলের জেরে ভুগছেন দেশের সাধারণ মানুষ। অথচ সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল একতরফা ভাবে।’’ তাঁর অভিযোগ, এর জন্য বিরোধী দল কিংবা রাজ্যগুলির সঙ্গে কথা বলা হয়নি। এমনকী এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সকলের মত যাচাই করা হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারেও। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী। তার মূলে জোরালো আঘাত।

এই প্রসঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র আগে তুলেছেন। এ দিন সাক্ষাৎকারে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখও করেছেন অমর্ত্যবাবু। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ করতে বিরোধীদের যে ভাবে একজোট হতে হত, তা তাঁরা পারেননি। পাল্টা গলা চড়াতে পারেননি এক সুরে। তাই গত দু’মাস এত দুর্ভোগের পরেও অনেক মানুষ যে এখনও ‘অন্ধ ভাবে’ নোট বাতিলের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তার কিছুটা দায় বিরোধীদেরও। একই সঙ্গে তাঁর আশঙ্কা, যত দিনে এই ঘোর কাটবে, উত্তরপ্রদেশ সমেত পাঁচ রাজ্যে ভোট তত দিনে সারা।

এ দিন আগাগোড়া চোখা-চোখা বাণে মোদী সরকারের নোট নাকচের সিদ্ধান্তকে বিঁধেছেন অমর্ত্যবাবু। তাঁর মতে, ‘‘এটি ভুল সিদ্ধান্ত কি না, তা নিয়ে আলোচনার কোনও জায়গা নেই। বরং এটি কত বড় ভুল, শুধু তা নিয়ে কথা হতে পারে।’’

প্রথমে কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ, তারপরে জাল নোট, সন্ত্রাসে টাকার জোগান বন্ধ করা হয়ে শেষমেশ নগদহীন অর্থনীতির তত্ত্ব (ক্যাশলেস ইকনমি)। ৮ নভেম্বর নোট নাকচের ঘোষণার পর থেকে বারবার তার কারণ বদলেছে কেন্দ্র। অমর্ত্যবাবুর মতে, এ থেকেই স্পষ্ট, শুরুতে কালো টাকার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছিল, তাতে জয় আসবে না বলে মেনে নিয়েছে তারা।

কিন্তু হালে কেন্দ্র যে একাধিক বার বলেছে, এই সিদ্ধান্ত আসলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের? সারা দুনিয়ায় এক ডাকে চেনা অর্থনীতিবিদের চাঁছাছোলা জবাব, ‘‘আমি মনে করি না এটা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিদ্ধান্ত। এই মুহূর্তে শীর্ষ ব্যাঙ্ক স্বাধীন ভাবে কোনও কিছু ঠিক করে বলেই মনে করি না আমি।’’ উল্লেখ্য, এ দিন সংসদীয় কমিটিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও জানিয়েছে যে, নোট বাতিলের সুপারিশ তাদের হলেও পরামর্শ সরকারের।

সম্প্রতি বারবার প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান গভর্নর উর্জিত পটেলের জমানায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতা বিপন্ন কি না। অনেকেরই অভিযোগ, তিনি সিদ্ধান্ত নেন কেন্দ্রর ইশারায়। পূর্বসূরি রঘুরাম রাজনের মতো প্রয়োজনে সংঘাতে গিয়েও মেরুদণ্ড সোজা রেখে নয়। এ দিন পটেলকে নাম করে সরাসরি আক্রমণ করেননি অমর্ত্যবাবু। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, ‘‘শীর্ষ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতার বিষয়ে আমি যে সাংঘাতিক রকমের বিপ্লবী, তেমনটা নয়। ...কিন্তু মনে হয়, মনমোহন সিংহ, রঘুরাম রাজন কিংবা আই জি পটেলের মতো গভর্নর থাকলে, তাঁর কথা অন্তত এক বার শুনতে বাধ্য হত কেন্দ্র।’’

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সংসদে বলেছিলেন, নোট নাকচের জেরে অন্তত দুই শতাংশ গোত্তা খাবে বৃদ্ধির হার। অমর্ত্যবাবুর মতে, শুধু জিডিপির শুক্‌নো হিসেবে এই ক্ষতির ছবিকে ধরতে পারা শক্ত। কারণ, অর্থনীতিতে নগদের জোগান কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পরে জিডিপি হয়তো কমবে বা বাড়বে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে যে মানুষগুলো ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গেলেন, তাঁদের জীবন ফিরবে না। পূরণ হবে না প্রান্তিক চাষি, ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষতি। এ দেশে মেয়েদের কাজ পাওয়ার সুযোগ এমনিতেই কম। এখন নগদের টানাটানিতে তা প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। তাঁর মতে, জিডিপিকে ঠেলেঠুলে যদি বা তোলা যায়, এই সমস্ত ক্ষতি অপূরণীয়। তাঁর কথায়, ‘‘শান্তিনিকেতনে গিয়ে দেখেছি, সেখানে আলু চাষ ধাক্কা খেয়েছে।’’ অর্থাৎ, জিডিপির হিসেবে তা চাপা পড়ে যেতে পারে। কিন্তু ভোগান্তি ভোলার নয়।

তা হলে এত কিছুর পরেও দেশের বহু মানুষ এখনও নোট বাতিলের পক্ষে কেন? নোবেলজয়ীর জবাব, ‘‘সাধারণ মানুষের মধ্যে হয়তো একটা আশা আছে যে, এতে কালো টাকা, জাল নোট, দুর্নীতি, ঘুষের কারবার সব কিছু বন্ধ হবে।...আর যখন সেই ঘোর কাটবে, তত দিনে পাঁচ রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভোট শেষ।’’

নগদে থাকা ৬-৭ শতাংশ কালো টাকাকে পিষে মারতে বাজার থেকে ৮৬% নোট তুলে নেওয়া যে বিরাট ভুল, এ দিন তা বহু বার বলেছেন অমর্ত্যবাবু। কালো টাকা, জাল নোট, কিংবা ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার— কোনও যুক্তিই ওই সিদ্ধান্তের পক্ষে ধোপে টেকে না বলে মনে করেন তিনি। বরং নোট বাতিল নিয়ে কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাগাতার সিদ্ধান্ত বদলে যাওয়ার কারণে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রতি আমজনতার আস্থা জোরদার ভাবে ধাক্কা খেতে পারে বলে তাঁর আশঙ্কা। তাহলে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের ভুল ভাঙলে, কী জবাবদিহি করবে মোদী সরকার? উত্তরে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের উদাহরণ টানছেন অমর্ত্যবাবু। বলছেন, রাশিয়া দখল করতে গিয়ে শোচনীয় পরাজয়ের পরে নেপোলিয়ন যদি বলতেন যে, আর তো কিছু করতে যাইনি। শুধু বরফ ঢাকা পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম! এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিছুটা সেই রকমই।

এ ক্ষেত্রে নেপোলিয়ন কে, তা আর বলার প্রয়োজন পড়েনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Modi Amartya Sen Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE