কলকাতায় ডেসমন্ড-শর্মিলা। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।
প্রত্যেকের জীবনে এক-একটা কাজের এক-একটা সময় আসে। এখন তাঁর গুছিয়ে সংসার করার সময়, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে চলার সময়। শুধু এক জন ‘আন্দোলনকারী’র পরিচয় নিয়ে জীবন কাটাতে চান না তিনি। যখন দরকার ছিল, তখন আন্দোলনেই মন দিয়েছিলেন। তবে এখন শান্তি চান। তা আসবে সহনশীলতার মাধ্যমে বলেই বিশ্বাস।
‘‘নিজের রাজ্যে আমাকে একটি লড়াইয়ের প্রতীক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু আমার পরিচয় তো শুধু তা নয়। আমিও এক জন সাধারণ নারী!’’ কলকাতায় এসে শনিবার এমনই সব কথা বললেন ইরম শর্মিলা চানু। নারীকেন্দ্রিক এক আলোচনাসভায় যোগ দিতে ব্রিটিশ স্বামী ডেসমন্ড কুচিনোর সঙ্গে এ শহরে এসেছেন তিনি। এ রাজ্যে এটিই প্রথম সফর তাঁদের।
নিজের রাজ্য ছেড়ে তামিলনাড়ুতে গিয়ে এই সবে সংসার পেতেছেন চানু। এ বার ইচ্ছে, এ ভাবেই চারদিক ঘুরে দেখবেন। স্বল্পভাষী শর্মিলার হয়ে ডেসমন্ড জানালেন, ঘরকন্না করতে দিব্যি লাগছে তাঁদের। শর্মিলার পাসপোর্ট হাতে পেলে ইংল্যান্ড থেকেও ঘুরে আসতে চান তাঁরা।
তবে কি বদলে গিয়েছে চানুর কাজের ধারা? বদলে গিয়েছেন তিনিও? মণিপুরের ভাল-মন্দ ভেবে পথে নামবেন না আর?
মণিপুরের কথা উঠতেই চানু আরও শান্ত হলেন যেন। চোখের কোণটা চিকচিক করে ওঠে সেই রাজ্যের প্রসঙ্গ ফিরতেই।
শর্মিলার হয়ে উত্তর দিতে শুরু করলেন ডেসমন্ড। চানু আন্দোলনকারী হয়ে জন্মাননি। তাই তাঁর বদলানোর কোনও প্রশ্নই উঠছে না, মত স্বামীর। তাঁর অভিযোগ, ‘‘এ দেশে কেউ কারও কথা ভাবেই না। শর্মিলার কথাও কেউ ভাবেননি।’’ তাই শুধু মণিপুর নয়, চানু এ বার থেকে সকল সাধারণ নাগরিকের জন্য কাজ করবেন।
আর আফস্পা (আর্মড ফোর্সেস স্পেশ্যাল পাওয়ার অ্যাক্ট)? তা প্রত্যাহারের দাবিতে লড়াই কি থেমেই গেল তবে? না তেমনও নয়। তবে সব কাজেই এ বার থেকে মধ্যমপন্থী হতে চান তিনি। তাই রাজনীতিতে আর নয়। শর্মিলার বক্তব্য, ‘‘দেখতে চেয়েছিলাম আমাকে কতটা ভালবাসে মানুষ। না হলে ভোটেও দাঁড়াতাম না।’’ নিজেকে মানবাধিকারের কর্মী বলেই মনে করেন তিনি। তবে তাঁর অভিমান, যাঁদের জন্য লড়েছেন, তাঁরাই ভালবাসেননি তাঁকে। বরং কারও কারও হাতে ব্যবহৃত হয়েছেন তিনি। তাই মিসেস কুচিনো এখন আর মণিপুরে আবদ্ধ রাখতে চান না নিজেকে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন এ বার থেকে। দরকার হলে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করবেন। যেমন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময়ে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছিলেন চানুর আন্দোলনের প্রতি। প্রয়োজনে তাঁর কাছে যাবেন চানু, যোগ করলেন ডেসমন্ড। শহরে এসে যদিও তাঁদের সঙ্গে কথা হয়নি মমতার।
তা ছাড়া রাজনৈতিক নেত্রী হিসেবে মমতার সঙ্গে কথা বলতে চান না তিনি। মুখ খুললেন শর্মিলা। সমাজের জন্য কাজ করতে গেলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই হবে। সেই কাজে সাহসী মহিলাদেরও প্রয়োজন তাঁর। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও এক জন মহিলা হিসেবে পাশে চান চানু।
বক্তব্যটা গুছিয়ে বলে দিতে ফের স্ত্রীকে থামান ডেসমন্ড। জানান, বাকি ভারতের থেকে আলাদা নয় মণিপুর। সেখানেও চলে পরিবারতন্ত্র। তাঁর বক্তব্য, লোকে বলেন উত্তর পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যে নাকি মেয়েরা প্রাধান্য পান। কিন্তু সে কথা ঠিক নয়। এক ভাইয়ের সঙ্গে চানুর দূরত্ব হয়ে যাওয়ার পরে তাঁর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেননি চানু। ‘‘আসলে সর্বত্র ছেলেরাই গুরুত্বপূর্ণ। সেইটাই প্রমাণ হয়েছে বারবার,’’ স্ত্রীর পাশে থাকার ভরসা জুগিয়ে মত প্রকাশ করেন চানুর স্বামী।
যে মণিপুরকে ঘিরে লড়াইয়ে নেমেছিলেন, সে রাজ্যে আর ফিরবেনই না শর্মিলা? এখনই নয়। তবে সেই দিনটাও আসবে। ‘‘ওর নিরাপত্তার কথা যে আমাকে ভাবতেই হবে,’’ জানালেন দায়িত্বপূর্ণ ডেসমন্ড। আর শর্মিলা? কী মত তাঁর? ‘‘বিয়ে করে নিজেকে কিছুটা হলেও সুরক্ষিত লাগে এখন,’’ শান্ত ভাবে উক্তি চানুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy