হাইলাকান্দি জেলার কাটলিছড়া আসন সব সময়ই ভোট-চর্চায় বিশেষ জায়গা করে নেয়। একেক সময় একেক কারণে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ছ’বারের বিধায়ক ও চার বারের মন্ত্রী গৌতম রায় এ বারও সেখানে লড়ছেন।
ওই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী রাজকুমার দাস। এআইইউডিএফ টিকিটে লড়ছেন সুজামউদ্দিন লস্কর। অনিল নাথ দাঁড়িয়েছেন সমাজবাদী পার্টির প্রতীকে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে অনিলবাবু এআইইউডিএফ প্রার্থী ছিলেন। সে বার গৌতম রায়কে তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিলেন। ময়দানে রয়েছেন আরও ১২ প্রার্থী।
স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় কাটলিছড়া কংগ্রেসের দখলে রয়েছে। মাত্র দু’বার নির্দল প্রার্থী হিসেবে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন তজমুল আলি লস্কর। বিধানসভায় কাটলিছড়ার প্রতিনিধিত্ব করেন কংগ্রেস নেতা গৌরীশঙ্কর রায় এবং সন্তোষ কুমার রায়ও। সন্তোষবাবু মন্ত্রী গৌতম রায়ের পিতা।
প্রথম বারের মতো গৌতম রায় নির্বাচনে জেতেন ১৯৮৫ সালে। সেই থেকে তিনি কাটলিছড়ার বিধায়ক। সব বারই যে তিনি নিশ্চিন্তে ভোটযুদ্ধ জিতেছেন, তা কিন্তু নয়। প্রথম বার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় নির্দল প্রার্থী তজমুল আলি লস্করের সঙ্গে। তখন এই আসনে বিজেপি প্রার্থী দেয়নি। স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং আরএসএস কর্মীদের অনেকে প্রকাশ্যে গৌতম রায়ের হয়ে কাজ করেন। ১৯৯১ সালে তাঁকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেন নির্দল সচ্চিদানন্দ উপাধ্যায়। সামান্য ভোটের ব্যবধানে উপাধ্যায়বাবু পরাজিত হন। ১৯৯৬ সালেও গৌতম রায়কে হিমসিম খেতে হয়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অগপ প্রার্থী বেনুলাল ঘোষ পরাজিত হন। ২০০১ সালে গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী হন তাঁরই ভগ্নীপতি প্রয়াত প্রতুলচন্দ্র দেব। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গৌতম রায়কে রীতিমত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেন এআইইউডিএফ প্রার্থী অনিল নাথ। তিনি ৩৩ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে গৌতমবাবুকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন। গত বিধানসভা নির্বাচনেও এআইইউডিএফ প্রার্থী জ্যোতিষচন্দ্র দেবের সঙ্গে গৌতম রায়ের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।
কমবেশি হলেও কাটলিছড়ায় গৌতমবাবু তিন দশক ধরে জিতে আসছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ফলাফল তাঁর অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জোর হোঁচট খায়। এআইইউডিএফ এক নম্বর হয়, তাই শুধু নয়, কংগ্রেস তিন নম্বরে পৌঁছয়। এআইইউডিএফ প্রার্থী পেয়েছিলেন ৪৩ হাজার ৬২৫ ভোট। বিজেপি প্রার্থী পান ৩২ হাজার ৬২৫ ভোট। কংগ্রেসের পক্ষে যায় ৩১ হাজার ৮৪৪ ভোট। তিরিশ বছরের মাথায় কাটলিছড়ায় প্রথম বার ধাক্কা খায় কংগ্রেস। তাই এ বার কাটলিছড়া নিয়ে কংগ্রেস যেমন প্রচণ্ড সচেতন, তেমনি বিরোধী বিজেপি, এআইইউডিএফ অনেক বেশি আশাবাদী। অসমে বিজেপির উত্থান ঘটায় গেরুয়া শিবির আসনটি দখলে তৎপর। অনেক ভেবেচিন্তে বিজেপি এখানে প্রার্থী করেছে এক ইঞ্জিনিয়ারকে। বিজেপি প্রার্থী রাজকুমার দাস রামমন্দির আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। বিজেপির জন্মলগ্ন থেকেই দলের সঙ্গে জড়িত তিনি। জীবিকার তাগিদে মাঝে বেশ কিছুদিন কাটলিছড়ার বাইরে থাকায় দলের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা শিথিল হলেও, তাঁর দাবি, সঙ্ঘকর্মী হওয়ায় সুবাদে তৃণমূল স্তরে পৌছতে অসুবিধা হচ্ছে না।
চাকরি জীবনে রাজকুমারবাবু কিছু দিন শিলচর পুরসভায় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। পরে চলে আসেন হাইলাকান্দি সর্বশিক্ষা মিশনে। সব শেষে ছিলেন এনআরএইচএম–এ। চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ভোটে লড়ছেন গৌতম রায়ের বিরুদ্ধে। তাঁর স্ত্রী রাষ্ট্রসেবিকা সমিতির প্রদেশ স্তরের কর্মকর্তা। বিজেপি শুরু থেকেই এই আসন নিয়ে আশাবাদী। এর কারণ হিসেবে, তাঁদের দাবি— কাটলিছড়ায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৩৮ জন ভোটারের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু।
আশাবাদী বদরউদ্দিন আজমলের দল এআইইউডিএফ-ও। প্রার্থী সুজামউদ্দিন লস্কর এক সময় গৌতম রায়ের কাছের লোক ছিলেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তিনি কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর বাবা প্রয়াত তজমুল আলি লস্কর কাটলিছড়া কেন্দ্র থেকে দু’বার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ ও ১৯৮৩ সালে।
বছরখানেক আগে মন্ত্রী গৌতম রায়ের সঙ্গে সুজামউদ্দিনের মতবিরোধ দেখা দেয়। তিনি কংগ্রেস ছেড়ে এআইইউডিএফ-এ যোগ দেন। আজমল কৌশলগত কারণেই এ বার গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করিয়েছেন। এখানে দলের ভাল প্রভাব রয়েছে। সেইসঙ্গে তিন দশকের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়ে পিতার আসনে জয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন সুজামউদ্দিন। মাত্র তিনদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন সুজামবাবুর বাবা প্রাক্তন বিধায়ক তজমুল আলি লস্কর। তাঁর জানাজায় হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে দাঁড়িয়েই বাবার অধরা কাজ তিনি করতে চান বলে জানিয়েছেন সুজামবাবু। বিজেপির রাজকুমার দাস এবং এআইইউডিএফের সুজামউদ্দিন লস্কর ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচার করছেন। সমাজবাদী প্রার্থী অনিল নাথও প্রচারে নেমে পড়েছেন। সঙ্গে এনসিপি-র মুনাইলাল রিয়াং উপজাতি ভোটকে সম্বল করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। গৌতমবাবু সভা-সমিতিতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। সভাতে তিনি সুজামউদ্দিনকে তাঁর শাগরেদ এবং রাজকুমার দাসকে তাঁর ঘরের লোক বলে মন্তব্য করছেন।
গত বিধানসভা নির্বাচনে কাটলিছড়া কেন্দ্রে কার্যত সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। গৌতমবাবু পেয়েছিলেন ৬৫ হাজার ৪৩৫ ভোট। এআইইউডিএফ প্রার্থী জ্যোতিষচন্দ্র দেবের ঝুলিতে যায় ৩৩ হাজার ৪৬৮ ভোট। মাত্র ৪ হাজার ৯৪৭ ভোট জুটেছিল বিজেপির জয়দীপা পালের। এ বার ছবিটা ভিন্ন, ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন কাটলিছড়ার মানুষ।