সুগত বসু
এক অধ্যাপক নীরবতা ভাঙতে চেয়ে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। অন্য আর এক অধ্যাপক লোকসভায় দাঁড়িয়ে খানখান করে দিলেন দলের নৈঃশব্দ! কুড়িয়ে নিলেন অন্য দলের প্রশংসাও।
অবশেষে জেএনইউ-কাণ্ড নিয়ে সরব হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল! লোকসভায় বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে অংশ নিয়ে তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বর্ণনা করে চাঁছাছোলা ভাষায় অভিযোগ তুললেন মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘স্বনিযুক্ত দেশপ্রেমীদের খবরদারির নিন্দা করছি। এর ফলে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি ছাত্র, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মী, সকলের অধিকার রয়েছে নিজের মতামত নির্ভয়ে ব্যক্ত করার। যদি সেই মতামত সরকারের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধে যায়, তবুও। দেশদ্রোহীর ভূত খোঁজা এবং লজ্জাজনক ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বলির পাঁঠা বানানো বন্ধ করুক সরকার!’’ এখানেই না থেমে ইতিহাসের অধ্যাপক সুগতবাবু আরও বলেছেন, ‘‘সন্দেহজনক, জোর করে বানানো কিছু তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ছাত্রসমাজের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া চলে না।’’
সুগতবাবুর এই বক্তৃতার পরে এক দিকে দৃশ্যতই খুশি সনিয়া ও রাহুল গাঁধী এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁকে। কংগ্রেসের নেতা শাকিল অহমেদ তাঁর বক্তৃতার প্রশংসা করে বিবৃতিও দিয়েছেন। কিন্তু তারই পাশাপাশি বেশ কিছু প্রশ্ন এবং প্রবল কৌতূহল তৈরি হয়েছে তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে। মাত্র তিন দিন আগেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে মুখ খোলায় দলেরই অন্য সাংসদ সৌগত রায়কে তিরস্কার করেছে তৃণমূল। বিধানসভার অধিবেশনে জেএনইউ এবং যাদবপুর-কাণ্ড নিয়ে বিরোধীদের আলোচনার দাবি উড়িয়ে দিয়েছে শাসক পক্ষ। তা হলে কি ইতিমধ্যে বাম এবং অন্য বিরোধীদের চাপ এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, নীরবতা ভাঙা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না তৃণমূলের?
তৃণমূল নেতৃত্বের ব্যাখ্যা অবশ্য অন্য। রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের কথায়, ‘‘আমরা বরাবরই বলে এসেছি, আমাদের যা কিছু বলার রয়েছে, তা আমরা সংসদীয় বিতর্কেই জোরালো ভাবে তুলে ধরব। বাইরে নয়। টিভির টক শো-র বাইরেও তো জীবন আছে!’’ তাঁর বক্তব্যে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, লোকসভায় (এবং কাল রাজ্যসভায়) জেএনইউ নিয়ে সরব হলেও বিষয়টি নিয়ে বাইরে নীরবতাই বজায় রাখবে তৃণমূল। রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে শাসক দলের কাছে বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর যে, এ ছাড়া অন্য উপায় নেই বলে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
দলীয় সূত্রের খবর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই বিরোধিতার স্বর তুলে ধরার কৌশল নিয়েছিলেন তৃণমূলের সংসদীয় নেতৃত্ব। কিন্তু তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, বরাবরেই মতোই সৌগতবাবু দলের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে নিজের মতামত প্রকাশ্যে এনে ফেলেছিলেন। তাই রুষ্ট হয়েছিলেন মমতা। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা বলছেন, ‘‘দলের পরামর্শ মতোই সুগতবাবু কৌশলে কিছু কথা লোকসভায় তুলেছেন। তার মধ্যে কোনও বিড়ম্বনা নেই। সৌগতবাবুর মতো একতরফা যাদবপুরের উপাচার্যের প্রশংসা করতে যাননি তিনি!’’
মোদী সরকারের উগ্র জাতীয়তাবাদকে বিঁধতে গিয়ে আজ রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, নেতাজির প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন সুগতবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আজ যাঁরা সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটাচ্ছেন, তাঁরা হয়তো কাল রবীন্দ্রনাথকেও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বলতে পারেন! কারণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইউরোপ ভ্রমণের পরে তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন, জাতীয়তাবাদের ভাল এবং মন্দ দু’টি দিকই রয়েছে। জার্মানির জাতীয়তাবাদকে রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছিলেন সঙ্কীর্ণ, স্বার্থপর এবং দুর্বিনীত বলে।’’ সুগতবাবু আজ এক হাত নিয়েছেন সিপিএমকেও। কানহাইয়া কুমারের বক্তৃতা ইউ টিউবে শুনেছেন জানিয়ে সুগতবাবু বলেছেন, অনেক বিষয়ে তিনি ওই ছাত্রনেতার সঙ্গে একমত আবার বহু বিষয়ে নয়। তাঁর কথায়, ‘‘এক জন শিক্ষক হিসাবে আমি তাকে বলতে চাই যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা অংশ নেননি। বরং, সঙ্কটজনক সময়ে ১৯৪২ সালের আন্দোলনে এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সময় তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।’’ তাঁর এই মন্তব্যের পরেই তরজা বাধে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম এবং তৃণমূলের কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে। কিছু ক্ষণ পরে ফের বক্তৃতা শুরু করেন সুগতবাবু। যিনি আবার এটাও বলেছেন, ‘‘কমিউনিস্ট না হলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা ভেবে আমি কানহাইয়া ও অন্য ছাত্রদের সমর্থন করছি।’’
কৌশলের নাম ভারসাম্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy