আমেরিকার সঙ্গে ‘সব রকম’ সমন্বয় রেখেই নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ‘সার্জিকাল অপারেশন’ চালিয়েছে ভারত। শুধু এক রাতের একটি অভিযানই নয়, এই প্রথম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে আমেরিকাকে পুরোপুরি পাশে পাচ্ছে ভারত। আগামী দিনে ইসলামাবাদকে কূটনৈতিক এবং কৌশলগত দু’রকম ভাবেই আরও কোণঠাসা করতে ভারতকে নিঃশব্দে সাহায্য করছে ওয়াশিংটন।
ভারতের সেনা অভিযান চলাকালীন নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড বর্মা ছিলেন ওয়াশিংটনে। সেখানে নির্ধারিত কাজ অসমাপ্ত রেখেই ‘বিশেষ বার্তা’ নিয়ে তড়িঘড়ি নয়াদিল্লি চলে এসেছেন তিনি। পাশাপাশি মার্কিন সেনেট আজ যে ভাষায় সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তোপ দেগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে বিরল বলে দাবি করছে বিদেশ মন্ত্রক।
সার্কের দেশগুলিও এখন একসুরে পাক সন্ত্রাসের নিন্দায় মুখর। বছর দেড়েক আগেও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ছিলেন ছিলেন পাকিস্তানের পরম মিত্র। তাঁর সরকারও আজ সরাসরি সমর্থন জনিয়েছে ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে। আফগান রাষ্ট্রদূত সইদা আবদালি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘পাকিস্তান ক্রমাগত মিথ্যাচার করে যেতে পারে না। জবাবদিহির দায় রয়েছে তাদের। পাকিস্তান যে সন্ত্রাসে মদত দেয়, এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।’’ আফগান অবস্থানকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছে ভারত।
সার্ক ‘স্থগিত’
ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, আফগানিস্তান যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়ার পরে আগামী নভেম্বরে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন হওয়ার সুযোগ এমনিতেই ছিল না। এর পর শ্রীলঙ্কাও আজ ‘যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসের নিন্দা করে জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানে সার্ক বৈঠকে তারা যোগ দেবে না। কারণ তারা মনে করে, আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন শান্তি ও নিরাপত্তা। ইসলামাবাদের বর্তমান পরিস্থিতি সার্ক সম্মেলন আয়োজনের উপযুক্ত নয়। পাকিস্তান তবু না মচকানোর নীতিতে অটল থেকে ঘোষণা করেছে, তাদের দেশে সার্ক সম্মেলন বাতিল হচ্ছে না। শুধু স্থগিত রাখা হচ্ছে। এর জন্য সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী করেছে তারা।
পাক ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ টুইটারে লিখেছেন, ‘‘গোটা অঞ্চলের সন্ত্রাস-বিরোধী মনোভাবের সামনে বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিতে হল ওদের।’’ সব মিলিয়ে এ বারে যা ঘটল, তা সার্কের ইতিহাসে বিরল। ৮টি দেশের মধ্যে ৫টিই সম্মেলন বয়কট করছে— এটা অভূতপূর্ব। সাউথ ব্লকের দাবি, আন্তর্জাতিক স্তরে পাক-বিরোধী এমন বার্তা আগে কখনও দেওয়া হয়নি।
চিনের দ্বারস্থ
ভারতের সেনা অভিযানের পর থমথম করছে নিয়ন্ত্রণরেখা। এরই মধ্যে কূটনৈতিক ভাবে তৈরি হচ্ছে স্পষ্ট দু’টি অক্ষ। ভবিষ্যতে যদি ভারত-পাক সংঘাতের তীব্রতা আরও বাড়ে এবং যার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না— তখন এই বিভাজন আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে।
ভারত যখন আমেরিকাকে পাশে নিয়ে চলছে, ঠিক সেই সময়ই পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন বেজিংয়ে। মাখদুম খসরু বখতিয়ার এবং আলম দাদ লালেকা, এই দুই পাক প্রতিনিধি সেখানে চিনা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করছেন। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে চিন উদ্বিগ্ন। চিনা নেতৃত্ব জানিয়েছেন যে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছেন।’ বিদেশ মন্ত্রক অবশ্য জানাচ্ছে, চিনের তরফে এখনও এমন কোনও সরকারি বার্তা পাওয়া যায়নি যে মনে হয়, তারা উরি হামলাকে সমর্থন করছে। বরং আলোচনার মাধ্যমেই ভারত-পাক সঙ্কট মেটানোর পরামর্শ দিচ্ছে তারা। আগামি মাসে গোয়ায় ‘ব্রিকস’ দেশগুলির সম্মেলনে বেজিংয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
নগ্ন পাকিস্তান
চিনকে তালিকায় না রেখেও, যে বিপুল আন্তর্জাতিক সমর্থন ভারত পাচ্ছে, তা পাকিস্তানের পক্ষে যথেষ্ট চাপের বলেই মনে করা হচ্ছে। মার্কিন সেনেটের পক্ষ থেকে পাঠানো মোদীকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের বিদেশনীতির অঙ্গই হল সন্ত্রাসবাদ, যা তারা আফগানিস্তান ও ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। দেখা যাচ্ছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান, লস্কর, জইশ-এর মতো সংগঠনগুলি এখনও পাকিস্তানের মাটিতে সক্রিয়। তারা যে শুধু ভারতকেই নিশানা করছে তা নয়, আফগানিস্তান এবং আমেরিকাও তাদের নিশানা। পাক মাটিতে এই ধরনের জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া যায় না।’ এটা ঘটনা, গত কয়েক বছরে পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চেহারাটা ক্রমশই উলঙ্গ হয়েছে আমেরিকা তথা পশ্চিম বিশ্বের সামনে। লস্কর, জইশ এবং হাক্কানি নেটওয়ার্ক ক্রমশই আফগানিস্তান সীমান্তে আমেরিকার রক্তচাপ বাড়িয়ে চলেছে। উদ্বেগের মাত্রাটা স্পষ্ট সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডেমোক্র্যাট প্রার্থ়ী হিলারি ক্লিটনের মন্তব্যেও। প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা তাঁর একটি অডিও টেপ প্রকাশ করেছে। তাতে হিলারিকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমরা আতঙ্কে আছি, কখন ওখানে অভ্যুত্থান হয়, কখন জেহাদিরা পরমাণু অস্ত্রের উপরে কব্জা কায়েম করে। তখন তো আত্মঘাতী জঙ্গির হাতেও থাকবে পরমাণু বোমা!’ দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে মার্কিন অর্থনীতিরও। তিতিবিরক্ত মার্কিন নেতৃত্ব তাই এই আপৎকালীন সময়ে গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা, সুস্থিতির প্রশ্নে ভারতের সঙ্গে দ্রুত প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়িয়ে নিতে চাইছেন।
অভিযান নিয়ে
মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র জন কার্বি আজ ভারত-পাকিস্তান চলতি পরিস্থিতি নিয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠকও করেছেন ওয়াশিংটনে। সেনা অভিযানের কথা হোয়াইট হাউস জানত কি না, বারবার এই প্রশ্ন করা হয়েছে কার্বিকে। প্রথমে তিনি এড়িয়ে যান। পরে সোজাসুজি জানতে চাওয়া হয়, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে যেহেতু জোরালো সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা রয়েছে, ভারতের এই ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’-টির ক্ষেত্রেও কি কোনও সমন্বয় ছিল? কার্বি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনও উত্তর নেই। আপনারা তো জানেন যে বিশেষ কোনও সামরিক অভিযান নিয়ে আমি কোনও কথা বলি না।’’ ‘বিশেষ কোনও সামরিক অভিযান’ নিয়ে মুখ না খুললেও মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্রের কথায়, ‘‘গোটা অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে আমরা ক্রমশই সমন্বয় ও সহযোগিতা বাড়াচ্ছি। অনেক ভাবেই তা করা যায়। তথ্য ভাগ করে বা সকলের সঙ্গে আলোচনা করে। তবে এ ব্যাপারে কোনও ধোপার ফর্দ এই মুহূর্তে আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, সহযোগী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিনিয়তই এ ব্যাপারে কাজ হয়ে চলেছে।’’
নুনের ছিটে
সোল-এ লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের সঙ্গে বৈঠকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গ্যুয়েন হে আজ পাক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতীয় পদক্ষেপকে ‘খোলাখুলি সমর্থন’ করেছেন। তবে পাকিস্তানের সন্ত্রাস-ঘায়ে নুনের ছিটেটি এসেছে মস্কো থেকে। সোভিয়েত জমানা থেকে বর্তমান রাশিয়া— মস্কো ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। কিন্তু ক’দিন আগে পাক সেনার সঙ্গে যৌথ মহড়া চালিয়েছে তারা। সাউথ ব্লক মনে করছে, মস্কোর অবস্থানে খানিকটা হলেও স্বচ্ছতার অভাব তৈরি হয়েছে। এ-হেন রাশিয়াও আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা আশা করে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে দমনের ক্ষেত্রে পাকিস্তান উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy