Advertisement
E-Paper

গর্ভসংস্কার! বলে বলে নাকি আর্যভট্ট-আইনস্টাইনদের জন্ম দেওয়া যাবে?

গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের চমকে দেওয়া বন্দোবস্ত। গর্ভাবস্থায় যদি গর্ভসংস্কার অনুশীলন করেন মা এবং পরিবার, তা হলে যেমন সন্তান চাইবেন, ঠিক তেমনই হবে। দাবি প্রতিষ্ঠানটির।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:২৪
সন্তানসম্ভবা মহিলারা যদি গর্ভসংস্কার প্রক্রিয়া অনুশীলন করেন, তা হলে যে রকম সন্তানের জন্ম তিনি দিতে চান, তেমন সন্তানই জন্মাবে। দাবি জামনগরের গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের। —প্রতীকী ছবি / রয়টার্স।

সন্তানসম্ভবা মহিলারা যদি গর্ভসংস্কার প্রক্রিয়া অনুশীলন করেন, তা হলে যে রকম সন্তানের জন্ম তিনি দিতে চান, তেমন সন্তানই জন্মাবে। দাবি জামনগরের গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের। —প্রতীকী ছবি / রয়টার্স।

হিউম্যান ক্লোনিং কি সম্ভব? একটা মানুষের অবিকল প্রতিরূপের জন্ম দেওয়া কি যায়? বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, খুব কঠিন। বিড়ালের বা ইঁদুরের ক্লোনিং সহজ। মানুষের ক্লোনিং অত্যন্ত কঠিন।

কিন্তু বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের ল্যাবরেটরি থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে গুজরাতের জামনগরের এক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের লোকজনের উদ্যোগে চালিত গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের দাবি, সব সম্ভব। আর একটা আইনস্টাইনও সম্ভব। আর একটা মধুবালাও সম্ভব।

কী ভাবে সম্ভব? ভারতের পশ্চিম প্রান্তে বহু প্রাচীন ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে এবং তপোবন-সুলভ ভঙ্গিতে চলতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির দাবি— গর্ভাবস্থায় কিছু স্তোত্রপাঠ, কিছু মন্ত্রোচ্চারণ, কিছু যোগাভ্যাস এবং আরও কয়েকটি অনুশীলনের মাধ্যমে ‘গর্ভসংস্কার’ করা হলেই একেবারে চাহিদা মতো সন্তান মিলবে।

শুনতে হাস্যকর লাগলেও, ‘গর্ভসংস্কার’ নামের এই তত্ত্ব হু হু করে বিকোচ্ছে ২০১৮ সালেও। জামনগরে রমরম করে চলছে গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্র, দেওয়া হচ্ছে গর্ভসংস্কারের বই এবং সিডি। আর মনের মতো সন্তান পাওয়ার আশায় দম্পতিরা দলে দলে ছুটছেন সে প্রতিষ্ঠানে। হুবহু ক্লোনিং-এর কথা বলছে না প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ঠিক আর্যভট্টের মতো মস্তিষ্ক বা ঠিক রাণা প্রতাপের মতো শরীর বা ঠিক ছত্রপতি শিবাজির মতো সক্ষমতা সম্পন্ন সন্তানের জন্ম দেওয়া সম্ভব বলে গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্র দাবি করছে।

জামনগরের প্রতিষ্ঠানটি বলছে— সন্তানকে কেমন দেখতে হবে, তার সক্ষমতা কেমন হবে, গুণাবলী কেমন হবে, সে সবই গর্ভসংস্কারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আদৌ সম্ভব এমনটা? স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে নানা শিবির থেকে। মীনা দাসানি বললেন, ‘‘১০০ শতাংশ নয়, ১০০০ শতাংশ সম্ভব।’’ মীনাবেন জামনগরেরই বাসিন্দা। গুজরাত সরকার দাম্পত্য সমস্যা মেটানোর জন্য থানায় থানায় যে কাউন্সেলরদের নিয়োগ করেছে, মীনাবেন তাঁদেরই এক জন। নিজেকে অবশ্য শুধু সরকারি কাউন্সেলিং-এর কাজে সীমাবদ্ধ রাখেন না তিনি। গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের দেখানো পথে গর্ভসংস্কারও করান। ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে মীনা দাসানির দাবি, ‘‘কেউ যদি চান যে তাঁর সন্তানের চোখ নীল হোক বা চুলে লাল আভা থাক, তা হলে গর্ভসংস্কারের মাধ্যমেই তেমনটা হওয়া সম্ভব। কেউ যদি চান তাঁর ছেলে বা মেয়ের মস্তিষ্ক আইনস্টাইনের মতো হোক, তা হলে গর্ভসংস্কারের মাধ্যমেই তিনি তেমন সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।’’

‘‘ছ’মাসের গর্ভাবস্থা এক মহিলার। চিকিৎসক জানালেন, গর্ভস্থ সন্তান ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত। দম্পতি বুঝতে পেরেছিলেন সুস্থ সন্তান জন্মাবে না। কিন্তু গর্ভপাতের কথা ভাবতেই পারেননি। গর্ভসংস্কারে ভরসা রেখেছিলেন। তাতে বিস্ময়কর ফল মিলেছে!’’ বলে চলেন মীনা। কী রকম বিস্ময়কর ফল? মীনা দাসানির কথায়, ‘‘সেই দম্পতি সম্পূর্ণ সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। শুধুমাত্র সুস্থই নয়, সেই সন্তান ওই দম্পতির আগের সন্তানের চেয়েও অনেক বেশি মেধাবী। এমনটা শুধুমাত্র গর্ভসংস্কারের কারণেই সম্ভব হয়েছে।’’

গর্ভসংস্কার কী?

সন্তানসম্ভবা মহিলাকে, তাঁর স্বামীকে এবং সম্ভব হলে গোটা পরিবারকে বেশ কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে, নির্দিষ্ট কিছু আচার-আচরণ অনুশীলন করতে হবে, কিছু বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণ করতে হবে, কিছু যোগাভ্যাস করতে হবে ইত্যাদি। গোটা গর্ভাবস্থা জুড়ে যদি এমনটা করা যায়, তা হলে সন্তান জন্মাবে কাঙ্খিত গুণাবলী নিয়েই। গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্র অন্তত এমনটাই দাবি করছে।

গর্ভসংস্কারের অঙ্গ হিসেবে যোগাভ্যাসও করানো হচ্ছে জামনগরের প্রতিষ্ঠানটিতে। ছবি: গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের ওয়েবসাইট থেকে।

প্রতিষ্ঠানটি অনেক দম্পতিকেই কাউন্সেলিং করছে। গর্ভাবস্থার কোন মাসে কোন মন্ত্র পাঠ করতে হবে, দিনের কোন সময়ে কী করতে হবে, মায়ের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের ভূমিকা কেমন হতে হবে— সে সব বিশদে শেখানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন: রাজস্থানের সচিবালয়ে ‘ভূত’! ভয়ে কাঁটা মন্ত্রীরা

আদৌ কি বিজ্ঞানসম্মত কথা বলছেন সঙ্ঘের এই ‘গর্ভবিজ্ঞানীরা’? স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ তথা বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসক গৌতম খাস্তগির হেসে ফেললেন। ‘‘যে দেশে টাকে চুল গজানোর মলম বিক্রি করা সম্ভব, সে দেশে আরও অনেক কিছুই সম্ভব।’’ বললেন তিনি। প্রথম সারির এই আইভিএফ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘যে দেশে লোককে বোকা বানানো এত সহজ, সে দেশে এক শ্রেণির লোক নিজেদের সারা জীবনটাই খুব সহজে কাটিয়ে দিতে পারেন শুধুমাত্র লোককে বোকা বানিয়ে। আর ভারতের জনসংখ্যা এত বেশি যে, ০.১ শতাংশ লোক বোকা বনতে প্রস্তুত থাকলেই, বহু লোকের কারবার জমজমাট হয়ে ওঠে।’’

মন্ত্রোচ্চারণ, বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তানের গুণাবলী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, এমন তত্ত্বের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যে থাকতে পারে না, সে নিয়ে আলোচনাই অনর্থক। মত গৌতম খাস্তগিরের।

সঙ্গীতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে গর্ভসংস্কারে। জানাচ্ছে জামনগরের প্রতিষ্ঠানটি। ছবি: গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের ওয়েবসাইট থেকে।

মিউজিক থেরাপি’র প্রসঙ্গও উঠল কথায় কথায়। মন্ত্রোচ্চারণ বা বৈদিক আচার-অনুষ্ঠান কি মিউজিক থেরাপির মতো কোনও প্রভাব ফেলতে সক্ষম? চিকিৎসক বললেন, গর্ভস্থ সন্তানের গুণাগুণ বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা মিউজিক থেরাপিরও নেই। ‘‘মানসিক শান্তি বা স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গান হয়তো কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা মহিলার পেটে থাকা সন্তান গানের প্রভাবে নির্দিষ্ট গুণ পাবে, এমনটা চিকিৎসা বিজ্ঞান অন্তত মনে করে না। ফলে আচার-অনুষ্ঠান বা মন্ত্রোচ্চারণের কোনও প্রভাব আদৌ থাকতে পারে কি না, সে নিয়ে কথা বলারই কোনও মানে হয় না।’’

সঙ্ঘ কী বলছে?

গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের কার্যকলাপ প্রসঙ্গে আরএসএস-এর অবস্থান বেশ সাবধানী। পশ্চিমবঙ্গ আরএসএস-এর শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে প্রথমেই দাবি করা হল, গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্র সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠান নয়। ‘‘সঙ্ঘের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কেউ কেউ হয়তো ওই প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন। কিন্তু জামনগরের প্রতিষ্ঠানটি সঙ্ঘের, এমন কথা বলা যায় না।’’ মন্তব্য নেতৃত্বের। পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও প্রতিষ্ঠান নেই বলেও তাঁরা জানালেন।

প্রতিষ্ঠান যাঁদেরই হোক, প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি সম্পর্কে আরএসএস নেতারা কী ভাবছেন? এমন কর্মসূচির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যে আদৌ নেই, তা কি সঙ্ঘের প্রচারকরা মানেন? নেতৃত্বের তরফে এ বার জানানো হল, ‘‘গর্ভসংস্কারের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, এ কথা ঠিক নয়।’’ রাজ্যস্তরের অন্যতম শীর্ষনেতার কথায়, ‘‘এই কর্মসূচিগুলি আসলে জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর। গর্ভস্থ সন্তানের উপরে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব তো থাকেই। সে সব মাথায় রেখেই গর্ভসংস্কার কর্মসূচি।’’

গর্ভসংস্কার কী ভাবে হয়, কতটা ফলপ্রসূ হয়, অ্যালোপ্যাথদের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। দাবি স্বয়ংসেবকদের। ছবি: গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের ওয়েবসাইট থেকে।

জামনগরের প্রতিষ্ঠানটিতে যাঁদের তত্ত্বাবধানে গর্ভসংস্কার চলছে, তাঁদেরই অন্যতম আয়ুর্বেদাচার্য হিতেশ জানি অবশ্য অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। কলকাতার গৌতম খাস্তগির কী বলছেন, সে কথা শুনে বেজায় চটে গেলেন জামনগরের হিতেশ জানি। বললেন, ‘‘গৌতম খাস্তগির কত বড় ডাক্তার জানি না। কিন্তু তিনি তো অ্যালোপ্যাথ। তিনি আয়ুর্বেদ জানবেন কী করে! তাঁর মতামত চাওয়াই তো উচিত হয়নি।’’ আধুনিক যুগের মেডিক্যাল সায়েন্সের সঙ্গে আয়ুর্বেদকে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে, মত হিতেশের। হাজার হাজার বছর ধরে সফল ভাবে গর্ভসংস্কার কর্মসূচির প্রয়োগ করে আসছে আয়ুর্বেদ, দাবি তাঁর। ‘‘গর্ভাবস্থায় মা কতটা শান্তিতে থাকছেন, কতটা ইতিবাচক চিন্তাভাবনার মধ্যে রয়েছেন, কী পড়ছেন, কী শুনছেন, কী খাচ্ছেন— এই সব কিছুই গর্ভস্থের উপরে প্রভাব ফেলে। গর্ভবিজ্ঞানের অস্তিত্ব সেখানেই।’’

আরও পড়ুন: খ্রিস্টান প্রধান রাজ্যে ক্রসই অস্ত্র মোদীর

তা বলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আইনস্টাইনের জন্ম দিয়ে দেওয়া যাবে? বলে বলে আর্যভট্ট বা রবীন্দ্রনাথ বা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তৈরি করে ফেলা যাবে? হিতেশ জানির ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি জবাব, ‘‘আর্যভট্ট কেন জন্মাবে? আর্যভট্টের মতো সন্তান জন্মাবে।’’

Garv Sanskar Garvbigyan Anusandhan Kendra gujarat RSS Pregnancy Rituals গর্ভসংস্কার গর্ভবিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্র গুজরাত আরএসএস
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy