Advertisement
E-Paper

একতলা ছেড়ে জল কি আমাদের ছোঁবে

গোড়ায় বিদ্যুৎ তা-ও আসা যাওয়া করছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে পুরো উনিশ শতকে চলে গিয়েছেন ওঁরা। শ্রাবণী মুখোপাধ্যায় আর তাঁর সাত বছরের মেয়ে সমার্থী। মাদ্রাজ স্কুল অব ইকনমিকস-এর শিক্ষক শ্রাবণী বুধবার বিকেলে কোনওমতে কথা বলতে পেরেছিলেন স্বামী দেবদুলাল ঠাকুরের সঙ্গে। গোয়ার বিট্‌স পিলানি প্রতিষ্ঠানে অর্থনীতির শিক্ষক দেবদুলাল।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:২২
ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

গোড়ায় বিদ্যুৎ তা-ও আসা যাওয়া করছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে পুরো উনিশ শতকে চলে গিয়েছেন ওঁরা।

শ্রাবণী মুখোপাধ্যায় আর তাঁর সাত বছরের মেয়ে সমার্থী। মাদ্রাজ স্কুল অব ইকনমিকস-এর শিক্ষক শ্রাবণী বুধবার বিকেলে কোনওমতে কথা বলতে পেরেছিলেন স্বামী দেবদুলাল ঠাকুরের সঙ্গে। গোয়ার বিট্‌স পিলানি প্রতিষ্ঠানে অর্থনীতির শিক্ষক দেবদুলাল। চেন্নাইয়ের মইলাপুরের ফ্ল্যাটে প্রদীপ জ্বালিয়ে এখন তাঁর স্ত্রী-মেয়ের দিন কাটছে। চাল-ডাল কিছুটা আছে। কিন্তু জলের জোগান প্রায় তলানিতে। ‘জল ফুরোলে কী করব, জানি না’— বুধবার বিকেলে স্ত্রীর এই কথা শোনার পরে স্বামীর অবস্থাও পাগল-পাগল।

দেবদুলালের কর্মস্থলে জনৈক তামিল সহকর্মী মইলাপুরের কাছেই থাকেন। কিন্তু তাঁদের কারও মোবাইলে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বহু কষ্টে ল্যান্ডলাইনে পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্ত্রী ও মেয়েকে একটু জল পৌঁছে দিতে কাতর আর্জি জানিয়েছেন দেবদুলাল। পরিচিতরা বলেছেন, একটা বড় বোতল পাঠানোর চেষ্টা করবেন। তবে তাঁদের পরামর্শ: ‘আপনার স্ত্রীকে বলুন, বৃষ্টির জল ধরে রাখতে। তবে সেটা ফুটিয়ে খাওয়াই ভাল।’

এর মধ্যেই কলকাতায় সেমিনারে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার কথা ছিল শ্রাবণীর। কিন্তু আকাশপথেও আপাতত গোটা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন চেন্নাই। শ্রাবণীর বৃদ্ধা মা ও মাসি আবার কন্যাকুমারী বেড়াতে গিয়েছিলেন। ট্রেন বাতিল হওয়ায় ওঁরা কন্যাকুমারীতে হোটেলবাসের মেয়াদ বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন।

দীপাবলির সময় থেকেই প্রবল বৃষ্টিতে জর্জরিত চেন্নাই। মাঝে তিন-চার দিন কমেছিল। কিন্তু গত সোমবার থেকে মুষলধারে ঢালছে। প্রায় দেড় দিন ধরে বিদ্যুৎবিহীন শহরে মোবাইলে চার্জ রয়েছে এমন লোকই গুটিকয়েক। ল্যান্ডলাইন পরিষেবা ধসে পড়েছে। বেঙ্গালুরুর স্কুলে ক্লাস ফোরের পড়ুয়া অর্ক চক্রবর্তীর মন খারাপ ছিল। তিন দিন ধরে বাবাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা নিলয়েন্দ্র চক্রবর্তী, কালপক্কমে ইন্দিরা গাঁধী সেন্টার ফর অ্যাটমিক রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী। থাকেন চেমবাক্কামে। এ দিন সন্ধেয় ফোনের ‘টাওয়ার’ পেয়ে নিলয়েন্দ্র কিছু ক্ষণ ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন।

চেমবাক্কাম এমনিতেই নিচু জায়গা। তার উপরে কাছে জিএসটি রোড। সেই রাজপথ এখন তিন ফুট জলের তলায়। এ দিন সকালে বৃষ্টি খানিকক্ষণ থেমেছিল। দুপুরের পর থেকেই আকাশ ফের কালো। নাগাড়ে ঝিরঝির। চেন্নাই আইআইটি-র শিক্ষক, আদতে সল্টলেকের বাসিন্দা শুভদীপ গঙ্গোপাধ্যায়কে সন্ধেয় বহু কষ্টে ফোনে ধরা গেল। বললেন, ‘‘পকেটে টাকা আছে, কিন্তু খাবার-জল ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না-থামলে কী করব জানি না।’’ নেট-কানেকশন’ও বন্ধ শুভদীপের। তবে ফ্রস্ট অ্যান্ড সালিভান সংস্থার এডিটিং ম্যানেজার তথা হস্তিনাপুরম, ক্রোমপেটের বাসিন্দা প্রকল্প ভট্টাচার্য বাড়ি থেকেই কাজ করছেন। সন্ধেয় ফেসবুক চ্যাটে ধরা গেল তাঁকে। বলছিলেন, মোবাইল অ্যাপস-এ ওলা-র নিখরচার নৌ-পরিষেবা শুরু হয়েছে। এনটিএল-ও নৌকো নামিয়েছে। গুটিকয়েক এলাকায় বাস চলছে। কিন্তু অটো বন্ধ। গাড়ি বার করা দুষ্কর। মঙ্গলবার অনেক জায়গাতেই লোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে পারেননি।

বেশির ভাগ জায়গাতেই বাড়ির একতলা জলের নীচে। দু’তলা-তিনতলার বাসিন্দারা কাঁটা হয়ে আছেন, এই বুঝি ফুলতে থাকা জলের বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলল তাঁদের। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে জল-ওষুধ মজুত চলছে ঘরে-ঘরে। সিনেমাহল, শপিং মল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিপন্নদের ভিড়।

ফেসবুকে ‘চেন্নাই বেঙ্গলি’-র পেজটায় এখন প্রিয়জনের মরিয়া খোঁজে বার্তার ছড়াছড়ি। দীপশ্রী দে তাঁর ভাই যিশু ভদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। সেতুলক্ষ্মী অ্যাভিনিউ, মনাপাক্কামের বাসিন্দা যিশু। দূর্বা মুখোপাধ্যায় তাঁর বোন শতরূপার জন্য উদ্বিগ্ন। দূর্বার বোন উষা স্ট্রিট, সীতাপতি নগর, ভেলাচেরির বাসিন্দা। প্রীতম সাহার আবেদন, শোলিঙ্গানাল্লুরের গোবর্ধন আবাসনে তাঁর বন্ধুর কাছে কি কেউ জল, খাবার পাঠাতে পারবেন? ঈপ্সিতা সেনগুপ্ত তাম্বারাম, পেরুঙ্গালাথুর, ভান্দালুর, উরাপক্কামে নৌকোর ‘হেল্পলাইন নম্বর’ পোস্ট করেছেন। চেন্নাইবাসী বাঙালিদের ‘ওয়ালে’ সৈদাপেট সেতু ভেসে যাওয়ার কিংবা জলমগ্ন তাম্বারাম পুর এলাকার ভিডিও-ছবি। দেড়তলা অবধি ডুবে থাকা বাড়ির পাশ দিয়ে ‘বোট’ চলেছে, দুর্গতদের নিয়ে।

অসহায়তার মধ্যেও বাঙালির রসবোধ এখনও অটুট। দু’দশকের চেন্নাইবাসী প্রকল্প এই বেনজির বৃষ্টির স্বাদ পেয়ে ‘ফেসবুকে’ লিখেছেন, ‘উফ্‌, রাস্তার সঙ্গে কেন ঘাট বলা হয়, তা এ বার টের পেলাম’!

water level chennai rain
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy