Advertisement
E-Paper

বিপ্লবের প্রচারের আলোর আড়ালে নিতি যেন প্রদীপের শিখা

ত্রিপুরায় বিজেপির অভূতপূর্ব জয়ের অন্যতম রূপকার বিপ্লবের ঠিক পাশে হুড খোলা জিপে দাঁড়িয়ে জনতার অভিনন্দন কুড়োলেও বাড়িতে একেবারে অন্য মানুষ নিতি।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৮ ১১:০৬
ত্রিপুরায় জয়ের পরে বিজয়-মিছিলে সস্ত্রীক বিপ্লব দেব। ছবি: পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।

ত্রিপুরায় জয়ের পরে বিজয়-মিছিলে সস্ত্রীক বিপ্লব দেব। ছবি: পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।

সার্কিট হাউস এলাকার জনসংখ্যা আচমকা বেড়ে গেল নাকি!

সাত-সকাল কিংবা নটার রাত, চেহারাটা একই। আগরতলা শহরের এই প্রান্তে, বাংলাদেশ ভিসা অফিসের পাশের গলিতে ঠিকঠাক দাঁড়ানোরও জায়গা থাকছে না। কখন দেখা হবে? কী ভাবে দেখা হবে? কেউ জানেন না। কারণ, এই গলির বাঁ হাতের একটি দোতলা বাড়ির এক তলার ভাড়াটে নিজেই তো তা জানেন না!

বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট বাগান। গেটের বাঁ দিকে নিরাপত্তা রক্ষীর চিলতে কিয়স্ক। কার্বাইনধারী রক্ষী সবিনয়ে বলেন, ‘‘স্যর, বলা আছে কি? ভিতর থেকে পারমিশন না পেলে ঢুকতে দেওয়া যাবে না স্যর।’’ সবই বলা আছে। সময়ও নেওয়া। কিন্তু তাতে কী? মোবাইলে বিপ্লব কুমার দেবের আপ্ত সহায়কের অসহায় গলা ভেসে আসে, ‘‘একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ। ভিতরে যে বসাবো, তার তো কোথাও কোনও জায়গাই নেই।’’

থাকবেই বা কী করে! ত্রিপুরার মানুষজন তো আছেনই। এই মুহূর্তে এ রাজ্যের সব থেকে চর্চিত নাম যাঁর, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন অসম, মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্যের মানুষজনও। সত্যিই ছোট্ট বাড়িতে পা ফেলার জো নেই। বাইরের বসার ঘর, চিলতে অফিস, মাঝের প্যাসেজ— সর্বত্র ফুলের ‘বোকে’ হাতে নেতা-কর্মী-সমর্থকের ভিড়।

আরও পড়ুন
শপথের আগেই ত্রিপুরা ভাগের দাবি তুলে ফেলল বিজেপির জোটসঙ্গী

অফিসঘর কাম চিলতে প্যাসেজের ডান পাশের খয়েরি রঙের কাঠের দরজার ও পাশে তখন বাইরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিপ্লব। নীল রঙের লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি ও সাদা চোস্ত পরা ৬ ফুটের সুদর্শন সুঠাম চেহারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। ব্যস্ত তাঁর স্ত্রী নিতি দেবও। সমানে এ ঘর-ও ঘর করছেন। চোখাচোখি হতেই মিষ্টি হেসে হাত নাড়লেন।

বিপ্লব দেবের মুখোমুখি আনন্দবাজার

আনুষ্ঠানিকতার বাকি আছে এখনও। এখনও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সরকারি ভাবে মুখ্যমন্ত্রী পদে কারও নাম ঘোষণা করেননি বটে, কিন্তু তালিকার একেবারে উপরের দিকে রয়েছে বিজেপি রাজ্য সভাপতি বিপ্লব কুমার দেবের নাম। এ ব্যাপারে কথা বলতে তিনি সতর্কও বটে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজি রয়েছেন, অমিতভাই আছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আছেন। তাঁরাই এটা ঠিক করবেন। তাঁরা যা করবেন, ত্রিপুরার ভাল ভেবেই করবেন।’’

দীর্ঘ দিনের আরএসএস-শিক্ষা, সঙ্গে ‘মেন্টর’ হিসেবে কে এন গোবিন্দাচার্যকে পাওয়া। দিল্লিতে আরএসএসের দফতর ‘কেশব কুঞ্জ’-এ প্রশিক্ষণ। পরে সুনীল দেওধরের সংস্পর্শে আসা। সর্বোপরি তাঁর বাবা হিরুধন দেব জনসঙ্ঘের স্থানীয় নেতা ছিলেন— এই সবটাই বিপ্লবকে মাটি কামড়ে লড়াই করতে শিখিয়েছে বলে মনে করেন তাঁর দলীয় সতীর্থরাই। দীর্ঘ পনেরো বছর ত্রিপুরার বাইরে ছিলেন তিনি। ছিলেন দিল্লিতে, মধ্যপ্রদেশের সাতনায়। তাই ২০১৬-য় যখন সুধীন্দ্র দাশগুপ্তকে সরিয়ে বিপ্লবকে ত্রিপুরা বিজেপির সভাপতি পদে বসানো হয়, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, যে রাজ্যে বিজেপির কার্যত কোনও অস্তিত্বই নেই, সেখানে এক জন ‘বহিরাগত’ কী করবেন?

বস্তুত, বিপ্লবের এই উত্থানের পিছনে সুনীল দেওধরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী কেন্দ্র বারাণসীর দায়িত্বে থাকা সুনীলের চোখে পড়েন বিপ্লব। মূলত সুনীলেরই পরামর্শে তাঁর হাতে ত্রিপুরা বিজেপির দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয়। তার পরের পর্বের কথা তো সকলেই জানেন।

তা হলে ৩ মার্চের (ভোটগণনার দিন) আগের ও পরের জীবনযাত্রায় কি কোনও তফাৎ হল? মৃদু হাসেন বিপ্লব। বলেন, ‘‘আমি যেমন আছি তেমনই থাকব। মনে হচ্ছে না কোনও তফাৎ হবে।’’

একই প্রশ্ন ছিল নিতি দেবের কাছেও। ত্রিপুরায় বিজেপির অভূতপূর্ব জয়ের অন্যতম রূপকার বিপ্লবের ঠিক পাশে হুড খোলা জিপে দাঁড়িয়ে জনতার অভিনন্দন কুড়োলেও বাড়িতে একেবারে অন্য মানুষ নিতি। আলাদা করে আড্ডা দেওয়ার আগে বললেন, ‘‘কথা বলার আগে ওকে এক বার জিগ্যেস করে নিন।’’ কী জিগ্যেস করব! বিপ্লব হেসে বলেন, ‘‘ওকে আর রাজনীতিতে নামাবেন না যেন।’’

অফিসঘর বা বাইরের কোথাও বসার জায়গা নেই। নিতি চলে আসেন ভিতরের ঘরে। পরিচারিকাকে বলেন, ‘‘ঘরটা ভাল করে পরিষ্কার কোর আর এখন কাচাকাচির দরকার নেই।’’ হাসেন নিতি, ‘‘আর বলবেন না, ঘর এক্কেবারে থইথই করছে। সময় পাওয়াটাই মুশকিল।’’ বিপ্লব ব্রেকফাস্ট করেছেন? ‘‘কোথায় আর! খেতেই চায় না। ওই যে দেখলেন ফলের রসটুকু খেল, ধমকে খাওয়ালাম।’’

বিপ্লবের স্ত্রী নিতির কথা

নিতি থাকেন দিল্লিতে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার। তাঁরই সঙ্গে তাঁর ছেলেমেয়েরা থাকে। ‘‘ছেলে আরেন মাধ্যমিক দেবে আর মেয়ে শ্রেয়া ক্লাস সিক্সে পড়ে।’’ ওদের পড়াশোনা কে দেখে? ‘‘প্রাইভেট টিউটর আছেন, তবে মূলত আমাকেই দেখতে হয়। না হলে পড়তে চায় না যে!’’ এখন? ‘‘এখন ওরা আছে ওদের দাদির কাছে।’’ নিতির গলায় চিরকালীন মাতৃত্বের সুর। ৩ মার্চের আগের আর পরের জীবন? ‘‘কাজের ব্যাপারে মোটামুটি একই আছে। তবে এই জীবনে আমরা অভ্যস্ত। লোকজন তো বরাবরই থাকত। বাবা-মা বলতেন, অতিথি নারায়ণ। আমি খুব খুশি হই লোকজন এলে।’’

এখন দীর্ঘ ছুটিতে আছেন নিতি। কিন্তু এপ্রিলেই হয়তো ফিরতে হবে তাঁকে। বিপ্লবকে ঘিরে হয়তো অনেক মানুষ থাকবেন। কিন্তু নিতি? একটু আনমনা দেখায় তাঁকে। প্রশ্নের উত্তরটা অন্য ভাবে আসে, বলেন, ‘‘আমার বাপেরবাড়ি জলন্ধরে। কিন্তু ও আমাকে একা রাখবে না। ওখানেও আমার সঙ্গে দু’দিন থাকবে। থেকে আমাকে সঙ্গে করেই নিয়ে আসবে। একা থাকবে না।’’

তা সত্ত্বেও এখন এমন অনেক সময় হয় যে, নিতির সঙ্গে বিপ্লবের হয়তো ফোনেও এক সপ্তাহ কথা হয় না। দেখা হয় দীর্ঘ দিন পরে পরে। গার্হস্থ্যের ন্যূনতম শর্তও মানা যায় না পরিস্থিতির চাপে। ‘‘অনেক সময় রাগ হয়, জানেন! তার পর বুঝি, ওর তো অনেক কাজ। মানুষের কাজ। মেয়েরা অনেক সময় খুব পজেসিভ হয়। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকি। ওর কাজে মাথা গলাই না। বাধা দিই না। ও ওর কাজ নিয়ে থাকুক। আমি তো ওর সঙ্গে সঙ্গেই থাকি!’’

আরও পড়ুন
ত্রিপুরা জুড়ে সন্ত্রাসের আবহ, লেনিনের মূর্তি ভাঙতে বুলডোজার

নিতি এই মুহূর্তে এক ব্যস্ত রাজনীতিকের স্ত্রী নন। তাঁর গলায় ভিন্ন সুর। চিরকালীন দাম্পত্যের, চিরকালীন পারিবারিক বন্ধনের, ঘরটাকে এক সুতোয় বেঁধে রাখার সুর যেন শুনতে পাই। ‘‘কিছু খেতে দিই, খেয়ে যান। একেবারে শুকনো মুখে চলে যাবেন না।’’ আর এক দিন হবে নিতি, সময় করে। আজ থাক।

বিপ্লবের অফিসঘরের ঝুলন্ত শোকেসে অনেক বইয়ের ভিড়ে একটি বইয়ের দিকে নজর যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। সব মানুষের জীবনই বুঝি সে রকম। প্রত্যেকের তার তার মতো করে।

ব্যস্ততা, প্রচারের তীব্র হ্যালোজেনের আড়ালে টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখতে হয় একটি পিদিমও, পূজাবেদীর সামনে রাখা পিদিমেরই মতো!

নিতি যে ভাবে তা জ্বালিয়ে রেখেছেন!

Tripura Tripura Assembly Election 2018 Biplab Deb Niti Deb Video
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy