Advertisement
E-Paper

ব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংস করার ‘অস্ত্র’ এই প্রথম খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা

গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে এক লহমায় ধ্বংস করে দিতে পারে এমন মারাত্মক শক্তিশালী একটি ‘বোমা’র খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম। এই ‘বোমা’র নাম- অ্যান্টি ম্যাটার। অ্যান্টি ম্যাটার যদি কোনও পদার্থ বা ম্যাটারের সংস্পর্শে আসে তাহলে অনিবার্য হয়ে ওঠে ধ্বংস বা অ্যানিহিলেশন। এক লহমায়। প্রথম যে অ্যান্টি ম্যাটারটির সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা, সেটি আসলে অ্যান্টি হাইড্রোজেন পরমাণু।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:০০
সার্নের আলফা গবেষণাগার।

সার্নের আলফা গবেষণাগার।

যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গেল।

গোটা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে এক লহমায় ধ্বংস করে দিতে পারে এমন মারাত্মক শক্তিশালী একটি ‘বোমা’র খোঁজ পেলেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম। এই ‘বোমা’র নাম- অ্যান্টি ম্যাটার।

অ্যান্টি ম্যাটার যদি কোনও পদার্থ বা ম্যাটারের সংস্পর্শে আসে তাহলে অনিবার্য হয়ে ওঠে ধ্বংস বা অ্যানিহিলেশন। এক লহমায়। প্রথম যে অ্যান্টি ম্যাটারটির সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা, সেটি আসলে অ্যান্টি হাইড্রোজেন পরমাণু।

২০ বছর ধরে নিরলস তন্নতন্ন তল্লাশের পর শেষ পর্যন্ত হদিশ মিলল এই ব্রহ্মান্ডের প্রথম কোনও অ্যান্টি ম্যাটারের। সুইৎজারল্যান্ডে জেনিভার অদূরে সার্ন-এর ভূগর্ভস্থ ‘আলফা’ গবেষণাগারে।

বিজ্ঞানীরা এই প্রথম দেখতে পেলেন কোনও অ্যান্টি ম্যাটার পরমাণুর (অ্যান্টি হাইড্রোজেন) দৃশ্যমান আলোর বর্ণালীতে (অপটিক্যাল স্পেকট্রাম)। বিজ্ঞানীরা সেই আলোর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক মাপতে পারলেন এই প্রথম।

ম্যাটার ও অ্যান্টিম্যাটারের মধ্যে সংঘর্ষ হলে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়

মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত হয়েছে এই আবিষ্কারের খবর। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার আগামী দিনে মহাকাশ গবেষণা ও আমাদের বাসযোগ্য গ্রহের প্রযুক্তি প্রকৌশল উন্নততর করার লক্ষ্যে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিল।

অ্যান্টি ম্যাটার কী জিনিস?

কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের অ্যাকাডেমিক ডিন বিশিষ্ট কণা পদার্থ বিজ্ঞানী সৌমিত্র সেনগুপ্ত বলছেন, ‘‘পদার্থ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা। আমাদের এত দিনের ধারণা ছিল ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি ছাড়া এই ব্রহ্মাণ্ডে আর যা কিছু আছে তাঁর সবটাই পদার্থ বা ম্যাটার। পদার্থ বা ম্যাটারের প্রতি বরাবরই একটা পক্ষপাত আছে এই ব্রহ্মাণ্ডে। নিয়মমতো এই ব্রহ্মাণ্ডে পদার্থ বা ম্যাটার আর অ্যান্টি ম্যাটারের পরিমাণ থাকা উচিত সমান সমান। কিন্তু অ্যান্টি ম্যাটারের অস্তিত্ব যেন মানতেই চায় না এই ব্রহ্মাণ্ড। সেটা কেন, কেন শুধু পদার্থের প্রতিই পক্ষপাত এই ব্রহ্মাণ্ডের, বিজ্ঞানীদের কাছে তার কারণটা এখনও অজানাই রয়ে গিয়েছে। কিন্ত এ বার এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণ হল ম্যাটারের প্রতি পক্ষপাত থাকলেও এই ব্রহ্মাণ্ডে অ্যান্টি ম্যাটারেরও অস্তিত্ব আছে। তার মানে এই ব্রহ্মাণ্ডকে এক লহমায় ধ্বংস করে দিতে পারে এমন ‘অস্ত্র’ ব্রহ্মাণ্ডর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। তবে এখনও প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি কেন অ্যান্টি ম্যাটারের চেয়ে পদার্থ বা ম্যাটারের প্রতি ব্রহ্মাণ্ডর এত বেশি পক্ষপাত। এ বার হয়তো সেই জট খুললেও খুলতে পারে। হয়তো জানা যাবে কী কারণে হাইড্রোজেন পরমাণুর মতো পদার্থ বা ম্যাটারের প্রতি বেশি পক্ষপাত এই ব্রহ্মাণ্ডের। আর এই ব্রহ্মাণ্ডে কেনই-বা ‘দুয়োরানি’ অ্যান্টি হাইড্রোজেনের মতো অ্যান্টি ম্যাটার। তবে স্ট্যান্ডার্ড মডেল যেমন বলেছিল, এখনও পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, ঠিক সেই ভাবেই মোটামুটি একই নিয়ম মেনে চলে ম্যাটার ও অ্যান্টি ম্যাটার। কিন্তু নিশ্চয়ই এমন কিছু কারণ রয়েছে, যার দরুন অ্যান্টি ম্যাটারের চেয়ে ম্যাটারের প্রতিই বেশি পক্ষপাত রয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডের। এ বার হয়তো সেই রহস্যের জট খুলবে।’’

আরও পড়ুন: পেসমেকার বানিয়ে নেবে হার্টই, চলবে আজীবন! নেপথ্যে ভারতীয় বিজ্ঞানী

আরও পড়ুন: মঙ্গলে আবার মিলল প্রাচীন সভ্যতার স্তম্ভ? নাসা কী বলছে?

ম্যাটার ও অ্যান্টি ম্যাটারের মধ্যে ফারাক কোথায়?

পেনসিলভানিয়া থেকে আমেরিকার ফের্মি ল্যাবে কর্মরত বিশিষ্ট কণা পদার্থ বিজ্ঞনী সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝালেন, ‘‘ যে কোনও পদার্থের পরমাণুর ঠিক কেন্দ্রে থাকে একটি নিউক্লিয়াস। যার মধ্যে থাকে দু’টি কণা। প্রোটন ও নিউট্রন। নিউট্রনের কোনও আধান বা চার্জ নেই। আর প্রোটনের আধান ধনাত্মক। সই নিউক্লিয়াসকে পাক মেরে পরমাণুর ভিতরে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘোরে ইলেকট্রন কণা। যে ভাবে বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে পাক মারে গ্রহগুলি।

কী চেহারা হয় ম্যাটার ও অ্যান্টি ম্যাটারের

প্রোটন ও ইলেকট্রন কণার আধান একেবারে সমান হয় বলে কোনও পরমাণুতে তা সমান সংখ্যায় থাকলে সেই পরমাণুটি নিরপেক্ষ বা নিউট্রাল হয়। তার কোনও আধান বা চার্জ থাকে না। সেটি ‘আয়ন’ হয় না। কিন্তু কোনও পরমাণুর ওপরে বাড়তি তাপ, চাপ বা চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে তাকে শক্তিশালী করে তুললে ইলেকট্রনগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ইলেকট্রনগুলি তখন পরমাণুর ভিতরের কক্ষপথ থেকে চলে যায় বাইরের কক্ষপথে বাড়তি শক্তি শুষে নিয়ে।

সার্নের ‘আলফা’ গবেষণাগারের মুখপাত্র কী বলছেন? দেখুন ভিডিও

আর সেই উত্তেজিত ইলেকট্রনগুলিকে যদি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয় তখন শুষে নেওয়া বাড়তি শক্তিটুকু ছেড়ে দিয়ে ইলেকট্রনগুলি আবার বাইরের কক্ষপথ থেকে আবার ভিতরের কক্ষপথে ফিরে আসে। আর তারা যে বাড়তি শক্তিটুকু ছেড়ে দিল সেটাই আলো হয়ে বেড়িয়ে আসে। সেই আলোরই বর্ণালী পরীক্ষা করে এ বার অ্যান্টি ম্যাটারের হদিস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।’’

কী চেহারা হয় হাইড্রোজেন ও অ্যান্টি হাইড্রোজেনের

এতে আগামী দিনে কী সুবিধে হতে পারে?

সৌমিত্রবাবু বলছেন, ‘‘প্রতিটি পদার্থেরই নিজস্ব আলোক বর্ণালী থাকে। তেমন প্রতিটি অ্যান্টি ম্যাটারেরও আলাদা আলোক বর্ণালী থাকে। সেই বর্ণালী বিশ্লেষণ করেই বিভিন্ন পদার্থের ধর্ম ও অবস্থা বোঝা যায়। এটাকে বলে স্পেকট্রোস্কোপি। এই স্পেকট্রোস্কোপির মাধ্যমেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মাণ্ডের অন্যপ্রান্তে থাকা তারাগুলি কী দিয়ে তৈরি তা জানা ও বোঝার চেষ্টা করেন। হাইড্রোজেন ব্রহ্মাণ্ডর সরলতম পরমাণু। এতে একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রোটন থাকে।

আলফা গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা

আর তার নিউক্লিয়াসে থাকে একটি নিউট্রন। প্রচুর পরিমাণে থাকে বলে হাইড্রোজনকে বোঝা এত সহজ। কিন্তু তার অ্যান্টি ম্যাটার- অ্যান্টি হাইড্রোজেনে থাকে একটি পজিট্রন ও একটি অ্যান্টি প্রোটন। এই অ্যান্টি হাইড্রোজেনও থাকে খুব সামান্য পরিমাণে। তাই তাকে পাওয়া খুব দুষ্কর হয়। কিন্তু এ বার তাকে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে ঘিরে ফেলে ধরে ফেললেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে আগামী দিনে ব্রহ্মাণ্ডর সৃষ্টি রহস্যের জট খোলার কাজ অনেকটাই সহজ হবে। আরও একটি মজার ঘটনা ঘটে গেল। বিশ শতকে হাইড্রোজেন পরমাণুর হাত ধরেই কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার আবিষ্কার হয়েছিল। এ বার সেই হাইড্রোজেন পরমাণুরই অ্যান্টি ম্যাটার- অ্যান্টি হাইড্রোজেনের হাত ধরে আবার একটি যুগসন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেলাম আমরা।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: সার্ন

Antimatter Discovered Anti Hydrogen Atom Cern Alpha Lab Cern
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy