Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্তন ক্যানসারের বাসা খুঁজে পেতে সস্তার দিশা বাঙালির

চেনাজানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটাও কাজে আসেনি। ম্যামোগ্রামে কিছু ধরা পড়েনি। হাত দিয়ে টিউমার বোঝা যায়নি। অথচ হাল্কা ব্যথা ছিল। স্তনবৃন্ত থেকে ক্ষরণও হচ্ছিল।

নিজের তৈরি ডাক্টোস্কোপির যন্ত্র হাতে অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র

নিজের তৈরি ডাক্টোস্কোপির যন্ত্র হাতে অপূর্ব মুখোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৪
Share: Save:

চেনাজানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটাও কাজে আসেনি। ম্যামোগ্রামে কিছু ধরা পড়েনি। হাত দিয়ে টিউমার বোঝা যায়নি। অথচ হাল্কা ব্যথা ছিল। স্তনবৃন্ত থেকে ক্ষরণও হচ্ছিল।

এমতাবস্থায় মুশকিল আসান হয়ে এল অপ্রচলিত একটি পরীক্ষা। স্তনের ‘মিল্ক ডাক্টে’ চুলের মতো সরু যন্ত্র ঢুকিয়ে অন্দরের হালহকিকত যাচাই করতেই ধরা পড়ল, স্তনের ভিতরের কোষে বাসা বেঁধেছে ক্যানসার!

ডাক্টোস্কোপি। বিদেশে চল থাকলেও ভারতে পদ্ধতিটির ব্যবহার এখনও বিরল। মূল কারণ— বিপুল ব্যয় ও যন্ত্রের গুণগত মান সম্পর্কে সংশয়। কিন্তু এখন আমেরিকা প্রবাসী এক বাঙালি বিজ্ঞানীর দাবি, তাঁর সংস্থা খুবই কম খরচে ডাক্টোস্কোপির সুযোগ দেবে। অপূর্ব মুখোপাধ্যায় নামে ওই বিজ্ঞানী ইতিমধ্যে মার্কিন মুলুকে তাঁর তৈরি ডাক্টোস্কোপের পেটেন্ট পেয়েছেন। দিল্লির এইম্‌স, আমদাবাদের এক হাসপাতাল ও কলকাতায় রাজারহাটের টাটা মেডিক্যাল সেন্টারকে যন্ত্র দানও করেছেন। তিন জায়গায় পরীক্ষামূলক ভাবে তার ব্যবহার চলছে। টাটা মেডিক্যালের চিকিৎসক রোজিনা আহমেদের কথায়, ‘‘আমরা কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষাটি করছি। কয়েকটা কেসে ক্যানসার ধরাও পড়েছে।’’

তবে এ দেশের নিরিখে ডাক্টোস্কোপির কার্যকারিতা বুঝতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন রোজিনা। পদ্ধতিটা অবশ্য একেবারে নতুন নয়। তা নিয়ে চিকিৎসক মহলে কিছুটা দ্বিমতও রয়েছে। কী রকম?

ডাক্তারদের একাংশের বক্তব্য: স্তনে টিউমার তৈরি হলে তবেই ম্যামোগ্রামে ধরা পড়ে। তাই দেরি হলে বহু ক্ষেত্রে রোগ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। ডাক্টোস্কোপিতে টিউমার হওয়ার আগেই আভাস পাওয়া সম্ভব। ফলে নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশি। আবার অন্য অংশের মতে, উপসর্গ না-থাকলে কেউ ডাক্টোস্কোপি’র মতো ‘ইনভেসিভ’ (শরীরের ভিতরে যন্ত্র ঢুকিয়ে) প্রক্রিয়ায় উৎসাহী হবে না। ‘‘আর সিম্পটমের পরে রোগ নির্ণয়ের জন্য তো অন্য অনেক টেস্ট রয়েছে!’’— মন্তব্য এক চিকিৎসকের।

কাজেই ওঁরা ডাক্টোস্কোপির তেমন প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না। এবং ঠিক এখানেই আপত্তি অপূর্ববাবুর। তাঁর যুক্তি, ‘‘স্রেফ ক্যানসার হওয়ার ভয়ে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ব্রেস্ট বাদ দিয়েছেন। দুনিয়া জুড়ে সাড়া পড়েছে। ক্যানসারের নেপথ্যে থাকা বিআরসিএ জিন নিয়ে চর্চা হচ্ছে। ডাক্টোস্কোপি’তে বিপদের সঙ্কেত আরও সহজে পাওয়া যাবে।’’ তাঁর দাবি, যাঁদের পরিবারে এক বা একাধিক ক্যানসার রোগী (অর্থাৎ হাই রিস্ক গ্রুপ), তাঁদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি খুবই ফলদায়ী। সরকারি হাসপাতালে তাঁর যন্ত্রে সস্তার ডাক্টোস্কোপি চালু হলে বহু জীবন বাঁচতে পারে বলে ওই বিজ্ঞানীর আশা। পরীক্ষাটা ঠিক কেমন?

অপূর্ববাবু জানিয়েছেন, এতে যন্ত্রণা বা রক্তক্ষরণ হয় না। দু’টি স্তন মিলিয়ে সময় বড় জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। পরীক্ষা সেরে বাড়ি চলে যাওয়া যায়। ‘‘এমন ভাবে যন্ত্রটা বানিয়েছি যে, হাসপাতালে মজুত সরঞ্জাম দিয়েই পরীক্ষা হবে। খরচ এক-দেড় হাজার টাকার বেশি পড়ার কথা নয়।’’— বলছেন তিনি। ওঁর দাবি: প্রি ক্যানসারাস সেলের অস্তিত্ব মালুমের পাশাপাশি স্তনে অন্য অস্বাভাবিকতা থাকলে ডাক্টোস্কোপি তা-ও বাতলে দিতে পারে।

মুর্শিদাবাদের তারগ্রামের ছেলে অপূর্ববাবু চল্লিশ বছর যাবৎ আমেরিকায়। যাদবপুরে বিই, শিবপুরে এমই, দিল্লি আইআইটি থেকে পিএইচডি করে বার্কলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায় গবেষণা শুরু করেছিলেন। মেডিক্যাল সরঞ্জাম নিয়ে গবেষণা দীর্ঘ দিনের। এরই ফলশ্রুতি কম খরচে ডাক্টোস্কোপি’র যন্ত্র। ভারতে ফি বছর লাখখানেক মহিলা স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এখানে পদ্ধতিটা কতটা কার্যকর হতে পারে?

ভিন্নমতও আছে। যেমন ক্যানসার সার্জন সৈকত গুপ্তের জবাব, ‘‘ডাক্টোস্কোপিতে প্রি-ক্যানসারাস অবস্থা বোঝা গেলেও এক-দু’সেন্টিমিটারের বেশি গভীরে কিছু বোঝা যায় না।’’ ব্রেস্ট কনসালট্যান্ট তাপ্তি সেন বলেন, ‘‘ ডাক্টোস্কোপি’র খরচ তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকা। কম খরচে করা গেলে কিছু ভাবা যেতে পারে।’’ ক্যানসার সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘খুবই সূক্ষ্ম বিষয়। আগে প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার। নচেৎ হিতে বিপরীত হবে।’’ আরজিকরের ক্যানসার বিভাগের প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় আশাবাদী। ‘‘ক্যানসার নির্ণয়ের যত দিশা মেলে, তত মঙ্গল। যাচাইয়ের চেষ্টা করতে দোষ কী?’’— প্রশ্ন তাঁর।

বস্তুত রোগ নির্ণয়ের বিলম্বে ক্যানসার ক্রমশ করাল চেহারা নিচ্ছে। অপূর্ববাবুর প্রয়াস সে ঘাটতি খানিকটা হলেও মেটাতে পারে বলে আশা করছেন কেউ কেউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Apurba Mukhopadhyay Breast Cancer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE