Advertisement
১৯ মার্চ ২০২৪

রোগ সারানোর দাওয়াই লুকিয়ে কোষ মানচিত্রে

ল্যাবরেটরিতে ডোপামিন উৎপাদক কোষ তৈরি করে তা যদি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দেওয়া যায়, পার্কিনসন্স ডিজিজ থেকে তা হলে মুক্ত করা যেতে পারে পৃথিবীকে!

দেবদূত ঘোষঠাকুর
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১০
Share: Save:

ল্যাবরেটরিতে ডোপামিন উৎপাদক কোষ তৈরি করে তা যদি মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দেওয়া যায়, পার্কিনসন্স ডিজিজ থেকে তা হলে মুক্ত করা যেতে পারে পৃথিবীকে! এটা এখন আর কোনও স্বপ্ন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা একত্রিত হয়ে যে গবেষণা শুরু করেছেন, তাতে এমনই সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।

মস্তিষ্কের ঠিক কতটা এলাকা জুড়ে ওই ডোপামিন উৎপাদক কোষগুলি রয়েছে, সেগুলির সঠিক সংখ্যাই বা কত— এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু জানতে হলে প্রয়োজন মানব শরীরের কোষ মানচিত্র। এত দিন পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোনও ধারণা ছিল না। আর তাই এখনও এই ধরনের কোষ প্রতিস্থাপনের গবেষণায় তেমন অগ্রসর হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। কারণ যদি নির্দিষ্ট জায়গায়নির্দিষ্ট সংখ্যক কোষ প্রতিস্থাপন করা না যায়, তা হলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে।

বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন গবেষণাগারে যে কাজটি এখন জোর কদমে চলছে তা হল মানব শরীরের কোষের মানচিত্র তৈরি করা। অর্থাৎ কোন অঙ্গে কী কী ধরনের কোষ রয়েছে, তাঁদের সংখ্যাই বা কত, শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলির অবস্থান কোথায় ঠিক কত পরিমাণ— এ বিষয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করাই ওই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য।

আপাতত এমআইটি-র ব্রড ইনস্টিটিউট, হার্ভার্ড এবং ব্রিটেনের ওয়েলকাম ট্রাস্ট স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউট এই গবেষণার প্রাথমিক কাজগুলি শুরু করেছে। বিশ্বের আর কোন কোন দেশের কোন কোন গবেষণাগারকে এতে যুক্ত করা হবে তা-ও ঠিক করবে ওই তিনটি সংস্থা।

গবেষকদের দাবি, আগামী ১০ বছরে এমন একটি মানব শরীরের প্রতিকৃতি তাঁরা তৈরি করতে পারবেন যার প্রতিটি কোষ থাকবে নীরোগ। ওই আদর্শ মানব শরীরটির কোষ মানচিত্রের সঙ্গে বিভিন্ন মানুষের কোষ মানচিত্র মিলিয়ে দেখা হবে। আর তখনই বোঝা যাবে কার শরীরে কোন কোষে কী ধরনের রূপান্তর ঘটছে। বিশেষঞ্জদের মতে, এর সাহায্যেই মোকাবিলা করা যাবে এডস, অ্যালঝাইমার্স, ক্যানসার বা পার্কিনসন্স ডি়জিজের মতো রোগগুলির সঙ্গে।

স্টকহলমের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ স্টেন নিলারসন এই গবেষণায় রীতিমতো উৎসাহিত। তাঁর কথায়, ‘‘কোষের ওই মানচিত্র আমাদের নতুন নতুন পথ দেখাবে। যে কোষগুলি কোনও রোগের ফলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে সেগুলিকে শরীরের বাইরে বা ভিতরে পুনর্জীবিত করা সম্ভব হবে।’’

শারীরবিদ্যার যে কোনও পাঠ্যপুস্তক অনুযায়ী মানুষের শরীর ২০০ বিভিন্ন ধরনের কোষের সমন্বয়ে তৈরি। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় এখন সামনে এসেছে, এই তথ্যটাই ভুল। জানা যাচ্ছে চোখের রেটিনাতেই শুধুমাত্র ১০০ বিভিন্ন প্রজাতির কোষ রয়েছে। দেহে রোগ প্রতিরোধী কোষ রয়েছে প্রায় ২০০ প্রকার। এই প্রতিটি কোষকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা গেলে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেক বেশি কার্যকর হবে বলেই মনে করছেন ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা।

সম্প্রতি লন্ডনে একটি বিজ্ঞান সম্মেলনে এই বিশ্বব্যাপী গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করেন। ব্রড ইনস্টিটিউট অব এমআইটি-র আভিভ রেজেভ ওই সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমরা এমন একটা গবেষণায় হাত দিয়েছি যাতে আমাদের শরীরের কোন কোষ কী কাজ করছে, কোন কোষ কী অবস্থায় রয়েছে, কোনটা কাজ বন্ধ করে দিলে কী হয়, কোন কোষ অতি সক্রিয় হয়ে গেলে কী হয়— এই সব বৃত্তান্তই আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।’’

অনেক মারণ রোগের হাত থকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ও এর ফলে খুব সহজেই সামনে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন রেজেভ। ‘‘আমাদের শরীর সম্পর্কে আমরা এতদিন যা জানতাম তা কোনও জানাই নয়। এ বার মানব শরীরকে জানার আসল প্রচেষ্টা শুরু হল,’’ মন্তব্য করেছেন গবেষক দলের এক প্রতিনিধি।

ইতিমধ্যেই এই গবেষণার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন রেজেভ। তিনি বলেন, মানব দেহে যে ৩৫ লক্ষ কোটি কোষ রয়েছে তার প্রতিটির জিনগত বিশ্লেষণ করা হবে। দেহের প্রতিটি কোষ কী কাজ করবে তা নির্ভর করে তাদের মধ্যে কোন জিনটি সক্রিয় তার উপরে। ‘‘এক ধরনের জিন সক্রিয় হলে কোনও কোষ নিউরনের কাজ করে। আবার অন্য এক ধরনের জিন সক্রিয় হলে ওই কোষই হৃৎপিণ্ডের কোষ হিসেবে ঘন ঘন সঙ্কোচিত ও প্রসারিত হয়,’’ বলেন গবেষক দলের এক প্রতিনিধি।

এই গবেষণা চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবেন বলে আশা করছেন এ দেশের বিজ্ঞানীরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী তুষার ঘোষ জানাচ্ছেন, স্নায়ুকোষ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে যে সব স্নায়ুরোগ হয়, যেমন পার্কিনসন্স ডিজিজ, স্ক্লেরোসিস, অ্যালঝাইমার্স— এই গবেষণার হাত ধরে এ সব রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি বেরিয়ে আসতে পারে। পার্কিনসন্স ডিজিজ নিরাময়ে বহু দিন ধরেই নানা চেষ্টা চলছে বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু কোনওটাই শতকরা ১০০ ভাগ সফল হয়নি। এখন এই মানচিত্রের দিকেই লক্ষ রাখতে হবে বলে মনে করছেন তুষারবাবু।

এসএসকেএম হাসপাতালের লিভার ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক-গবেষক অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘এর আগে জিনোম প্রোজেক্টে বিশ্বের নানা গবেষণাকেন্দ্র একসঙ্গে মানব শরীরের কোষগুলির জিনগত পরিবর্তন দেখেছে। সেটাই কিন্তু সব নয়। তবে এ বার যে গবেষণাটি শুরু হতে চলেছে তাতে শরীরের অনেক গভীরে ঢোকা যাবে।’’

‘‘কোষ মানচিত্র তৈরির এই গবেষণায় সবাই মিলে চেষ্টা করলে ১০ বছর পরে হয়তো একটা যুগান্তকারী জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে,’’ মন্তব্য করেছেন কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির ভাটনগর পুরস্কার পাওয়া কোষ বিজ্ঞানী শুভেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

স্থায়ী কোষের পাশাপাশি মানব দেহে বেশ কিছু সচল কোষও রয়েছে। সেগুলি ঘুরে বেড়ায় সারা দেহ জুড়ে। গবেষকেরা ওই সব কোষের মানচিত্র তৈরির ব্যাপারেও সচেষ্ট হবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন কলকাতার বিজ্ঞানীরা। তাঁরা মনে করেন তা হলেই ওই বিশ্বব্যাপী গবেষণার ‘ষোলো কলা’ পূর্ণ হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cell map Diseases healing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE