Advertisement
E-Paper

ছুঁচ না ফুটিয়েই শিশুদের দেওয়া যাবে যে কোনও ধরনের টিকা?

আর ছুঁচ ফোটানোর যন্ত্রণা হয়তো সইতে হবে না দুধের শিশুদের। তাদের মুখের মধ্যেই পুরে দেওয়া যাবে একটা ‘ট্যাবলেট’। যা মুখের ভেতরে ঢুকে একটু চাপ পেলেই অনেকটা জলকামানের মতো ছিটিয়ে দিতে শুরু করবে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের টিকাগুলি।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৭ ১০:৪০
ছবির ইনসেটে গবেষক নীরেন মূর্তি (বাঁ দিক থেকে) এবং অধ্যাপক মহম্মদ রফি

ছবির ইনসেটে গবেষক নীরেন মূর্তি (বাঁ দিক থেকে) এবং অধ্যাপক মহম্মদ রফি

আর ছুঁচ ফোটানোর যন্ত্রণা হয়তো সইতে হবে না দুধের শিশুদের।

মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার সময়েই কান্না দিয়ে যারা বুঝিয়ে দেয় জীবনযন্ত্রণার অর্থটা তারা বুঝতে পেরেছে, সেই শিশুদের বাড়তি যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায় টিকা। জন্মের মুহূর্ত থেকেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিভিন্ন ধরনের টিকা দেওয়ার জন্য বার বার শিশুদের নরম তুলতুলে চামড়ায় ইয়া বড় বড় ইঞ্জেকশনের ছুঁচ ফোটানো হয়। যন্ত্রণায় চিল-চিৎকার জুড়ে দেয় শিশুটি। তাকে থামাতে তখন হুলস্থুল পড়ে যায় গোটা বাড়িতে।

সেই ‘জীবন-যন্ত্রণা’ সইবার দিন বোধহয় এ বার শেষ হতে যাচ্ছে শিশুদের। আর ইঞ্জেকশনের ছুঁচ ফুটিয়ে টিকা দেওয়ার জন্য শিশুদের যন্ত্রণা দিতে হবে না। তাদের মুখের মধ্যেই পুরে দেওয়া যাবে একটা ‘ট্যাবলেট’। যা মুখের ভেতরে ঢুকে একটু চাপ পেলেই অনেকটা জলকামানের মতো ছিটিয়ে দিতে শুরু করবে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের টিকাগুলি। আর খুব তোড়ে বেরিয়ে আসা সেই টিকার অণুগুলি কোষের দেওয়াল (সেল মেমব্রেন) টপকে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়বে মুখের প্রতিরোধী কোষগুলিতে (ইমিউন সেল)। কঠিন কঠিন রোগগুলি মোকাবিলার জন্য শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করে তুলতে মুখের প্রতিরোধী কোষগুলির ‘পেশি’তে বল এনে দেবে ওই টিকার অণুগুলি।


গবেষণাগারের পেট্রিডিশে রাখা সেই সদ্য আবিষ্কৃত মিউকোজেট

এই সদ্য আবিষ্কৃত প্রযুক্তিটির নাম- ‘মিউকোজেট’। বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষকদল এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। যে গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে দুই ভারতীয় বায়োইঞ্জিনিয়ার নীরেন মূর্তি ও মহম্মদ রফির। একেবারে হালে (৮ মার্চ, ২০১৭) তাঁদের গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন’-এ।

কী ভাবে ইঞ্জেকশনের ছুঁচ না ফুটিয়েই টিকা দেওয়া যাবে দুধের শিশুদের?

বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভারতীয় অধ্যাপক নীরেন মূর্তি তাঁর ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘খরগোশের ওপর আর গবেষণাগারে আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এই ‘মিউকোজেট’ প্রযুক্তি অত্যন্ত কার্যকরী হয়েছে। ওই প্রযুক্তির মাধ্যমে মুখের বাক্কাল রিজিওনে জলকামানের মতোই অত্যন্ত উচ্চ চাপে তরল রাসায়নিক পদার্থ ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। তার সঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে মুখের ভেতরের প্রতিরোধী কোষগুলিকে জাগিয়ে তোলার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থও। যা মুখের ভেতরের বাক্কাল রিজিওনে প্রতিরোধী কোষগুলির মিউকাসের বাধা ডিঙিয়ে ঢুকে যেতে পারবে কোষগুলির মধ্যে। দাঁত তোলার সময় অনেকটা একই কাজ করে থাকেন ডাক্তাররা। যাকে বলা হয়, ‘ওয়াটার পিক’। প্রতিরোধী কোষ বা ইমিউন সেল ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের দেহের সর্বত্র। কিন্তু মুখের বাক্কাল রিজিওনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রতিরোধী কোষ। কিন্তু এত দিন সেই প্রতিরোধী কোষগুলির মিউকাসের বাধা পেরনো সম্ভব হয়নি। তার কারণ, মিউকাসগুলি খুব পুরু হয়। তাকে ভেদ করে ভেতরে ঢোকার মতো প্রযুক্তি আমাদের হাতে ছিল না। যদিও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা দেওয়ার কিছু ক্ষেত্রে মুখের ভেতর ঢোকানো এই ধরনের স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে।’’

মিউকোজেট প্রযুক্তি কী, কেন? দেখুন ভিডিও।

টিকা দেওয়ার জন্য যে ভাবে মুখের ভেতর ঢোকানো হবে মিউকোজেট

ওরাল ভ্যাকসিনেশনের এই অভিনব প্রযুক্তির খুঁটিনাটি কী কী?

সহযোগী গবেষক, বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আরেক ভারতীয় অধ্যাপক মহম্মদ রফি তাঁর ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘মিউকোজেট আসলে একটা চোঙ। যা লম্বায় ১৫ মিলিমিটার। আর যার ব্যাস ৭ মিলিমিটার। যার দু’টি প্রকোষ্ঠ। যা জলনিরোধক প্লাস্টিক রেজিন দিয়ে বানানো। বাইরের প্রকোষ্ঠে ২৫০ মিলিলিটার জল থাকে। আর ভেতরের প্রকোষ্ঠটিতে রয়েছে দু’টি ছোট ছোট খুপরি বা চেম্বার। যাদের মাঝে রয়েছে একটি প্লাস্টিকের খুব পাতলা আস্তরণ। আর প্লাস্টিকের সেই পাতলা আস্তরণটা অনেকটা ব্লটিং পেপারের মতো। তার ভেতর খুব ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে। ওই দু’টি ছোট ছোট চেম্বারের একটিতে (ভ্যাকসিন চেম্বার) থাকে বিভিন্ন রোগের টিকার ১০০ মিলিলিটারের একটি দ্রবণ। যার এক দিকে থাকে একটা পিস্টন। আর সেই ছোট চেম্বারের অন্য দিকটায় থাকে ২০০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের একটি ডেলিভারি নোজ্‌ল।


৮ মার্চ ‘সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রটি

যা দিয়ে ওই টিকার দ্রবণ পিস্টনের দেওয়া চাপে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে মুখের বাক্কাল রিজিওনের প্রতিরোধী কোষগুলির ভেতরে, তাদের মিউকাস ভেদ করে। আরেকটি যে ছোট চেম্বার (প্রোপেল্যান্ট চেম্বার) রয়েছে, তাতে থাকে শুকনো সাইট্রিক অ্যাসিড ও সোডিয়াম বাইকার্বনেট পাউডার। মুখের ভেতর ঢোকানোর পরে ওই শুকনো রাসায়নিক পদার্থগুলি তীব্র চাপে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস তৈরি করতে শুরু করে। সেই গ্যাসই দারুণ চাপ দিতে থাকে পিস্টনটার ওপর। তখন পিস্টনটা প্রচণ্ড চাপ দিয়ে টিকার দ্রবণটিকে ঠেলে নোজ্‌লের মুখ দিয়ে বের করে দেয়। আর নোজ্‌লের মুখ থেকে তোড়ে বেরিয়ে আসার পর সেই টিকার দ্রবণ খুব সহজেই মুখের প্রতিরোধী কোষগুলির মিউকাস ভেদ করে ঢুকে পড়তে পারে কোষগুলির অন্তরে-অন্দরে। এই ভাবে আমরা মুখের প্রতিরোধী কোষগুলিকে জাগিয়ে তোলার জন্য ওভালবুমিন নামে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিনও ঢুকিয়ে দিতে পেরেছি।’’

আরও পড়ুন- রক্তে চিনি মিশিয়ে শরীরে বিষ ঢালছে আমাদের মগজ!

টিকা দেওয়ার জন্য হয়ত আর যেতে হবে না ক্লিনিকেও!

অন্যতম প্রধান গবেষক, ভারতীয় অধ্যাপক নীরেন মূর্তি বলছেন, ‘‘আমরা ওই মিউকোজেটের আকার, আকৃতি আরও কমাতে চাইছি। চাইছি, ওই প্রযুক্তিকে এমন ভাবে ব্যবহার করতে, যাতে টিকা দেওয়ার জন্য শিশুদের আর ক্লিনিকে নিয়ে যেতে না হয়। লালিপপ খেতে খুব ভালবাসে শিশুরা। সেই লালিপপের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে এই মিউকোজেট। যা শিশুরা গিলেও ফেলতে পারবে অনায়াসে। তাতেও তার কোনও ক্ষতি হবে না।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে

Oral Vaccination Needle-Free Vaccination MucoJet
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy