Advertisement
E-Paper

এ বার ডেঙ্গির টিকাও বেরিয়ে গেল!

তাকে রোখার প্রাথমিক হাতিয়ার কি তা হলে আমাদের হাতে চলে এল? যাতে সে আমাদের শরীরে ঢুকে পড়লেও কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তাকে নিষ্ক্রিয়, ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য কি শেষমেশ আমাদের সাহায্য করল তারই কোনও ‘দোসর’? তাকে ‘বধ’ করার জন্য কি মানুষের বিশ্বাস জিতে নিতে চলেছে তারই কোনও এক ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’?

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ১৩:২৯
ডেঙ্গি ছড়ানোর মশা এডিস।

ডেঙ্গি ছড়ানোর মশা এডিস।

তাকে রোখার প্রাথমিক হাতিয়ার কি তা হলে আমাদের হাতে চলে এল?

যাতে সে আমাদের শরীরে ঢুকে পড়লেও কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।

তাকে নিষ্ক্রিয়, ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য কি শেষমেশ আমাদের সাহায্য করল তারই কোনও ‘দোসর’? তাকে ‘বধ’ করার জন্য কি মানুষের বিশ্বাস জিতে নিতে চলেছে তারই কোনও এক ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’?

ডেঙ্গির ভাইরাসের কথা বলছি।

যার কোনও এক ‘বিভীষণ’কে দিয়ে বানিয়ে ফেলা হয়েছে ডেঙ্গির ভ্যাকসিন।টিকা। বিশ্বে এই প্রথম।


ডেঙ্গি ভাইরাসের সেরোটাইপ ডেন-১

এমনটাই দাবি করেছেন আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে’র (নিএইড) ভাইরোলজিস্ট স্টিফেন হোয়াইটহেড ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা। তাঁদের পরীক্ষা-নির্ভর গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘দ্য লাইভ অ্যাটেন্যুয়েটেড ডেঙ্গি ভ্যাকসিন টিভি-০০৩ এলিসিট্‌স কমপ্লিট প্রোটেকশান এগেনস্ট ডেঙ্গি ইন আ হিউম্যান চ্যালেঞ্জ মডেল’। গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায়।

গবেষণাপত্রটি রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। কারণ, ডেঙ্গি যে শুধুই কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ আর ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিরই উদ্বেগের কারণ, তা নয়। ডেঙ্গির আতঙ্কে তটস্থ হয়ে থাকতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে। ফি-বছরেই। একেবারে হালে ডেঙ্গি মহামারী হয়ে উঠেছে পুয়ের্তো রিকোয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (‘হু’) পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ফি-বছর ডেঙ্গি জ্বরে বিশ্বে আক্রান্ত হচ্ছেন গড়ে ৩৯ কোটি মানুষ!

সদ্য প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি কেন হঠাৎ এত আলোড়ন ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে?

তার কারণ, পরীক্ষামূলক ভাবে ওই ভ্যাকসিনটি মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দেখা গিয়েছে, ওই টিকা যাঁরা নিয়েছেন ডেঙ্গির ভাইরাস তাঁদের আদৌ কাবু করতে পারেনি। আমেরিকার দু’টি জায়গায় চালানো হয়েছে ওই পরীক্ষা। বার্লিংটনের ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভারমন্ট কলেজ অফ মেডিসিন’ আর বাল্টিমোরের ‘জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথে’। পরীক্ষাটি চালানো হয়েছে মোট ৪১ জনের ওপরে। তাঁদের মধ্যে ২১ জনকে দেওয়া হয়েছিল সদ্য আবিস্কৃত ভ্যাকসিনটি। বাকি ২০ জনকে দেওয়া হয়েছিল শুধুই প্লেসবো ইঞ্জেকশান। তার ৬ মাস পরে তাঁদের শরীরে কৃত্রিম ভাবে ঢোকানো হয় ডেঙ্গির ভাইরাস। তাতে দেখা গিয়েছে, যে ২১ জনকে ডেঙ্গির টিকা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কিছুই করতে পারেনি ডেঙ্গির ভাইরাস। আর যে ২০ জনকে দেওয়া হয়েছিল প্লেসবো ইঞ্জেকশান, ডেঙ্গির সেই ভয়ঙ্কর জ্বর তাঁদের না হলেও, তাঁদের গায়ে লাল রঙের চাকা চাকা ‘র‌্যাশ’ বেরিয়েছে। যার মানে, অল্প হলেও ডেঙ্গির ভাইরাস তাঁদের শরীরের ক্ষতি করেছে।


ডেঙ্গি ভাইরাসের সেরোটাইপ ডেন-২

কী ভাবে বানানো হয়েছে ডেঙ্গির টিকা?

সহযোগী গবেষক বাল্টিমোরের ‘জন হপকিন্স ব্লুমবার্গ স্কুল অফ পাবলিক হেলথে’র ভাইরোলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মাধুরী সিংহের ব্যাখ্যায়, ‘‘ডেঙ্গির মোট চার ধরনের ভাইরাস রয়েছে। ‘ডেন-১’, ‘ডেন-২’, ‘ডেন-৩’ আর ‘ডেন-৪’। এগুলোকে বলা হয় ‘সেরোটাইপ’। জিকা ভাইরাস যাদের মাধ্যমে ছড়ায়, সেই ‘এডিস মসক্যুইটোজ’ প্রজাতির মশারাই এই ভাইরাসের বাহক।প্রতিপালক। আমাদের কাজটা হয়েছে ‘ডেন-২’ ভাইরাসকে নিয়ে। ডেঙ্গি ভাইরাসের অন্য ‘সেরোটাইপ’গুলোর তুলনায় ‘ডেন-২’ একটু দুর্বল। তার ‘ছোবলে’ একটু কমই থাকে ‘বিষ’। এই ভাইরাসগুলোকে মূলত পাওয়া যায় আফ্রিকার দেশ-কিংডম অফ টোঙ্গায়। আমরা ওই ‘ডেন-২’ ভাইরাসেরই একটা অবিকল ‘জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ভার্সন’ বানিয়েছিলাম। যাকে বলা হয় ‘জিএমভি’। ‘ডেন-২’-এর ‘জিএমভি’ দিয়েই বানানো হয়েছে ওই টিকা। যার নাম-‘TV003’। অনেকটাই নিরাপদে পরীক্ষা চালানো যায় বলে টিকা বানানোর জন্য আমরা ‘ডেন-২’-এর ‘জিএমভি’-কে বেছে নিয়েছিলাম। যাতে রক্তে ওই ভাইরাস মিশে গেলেও (যাকে বলা হয়, ‘ভাইরেমিয়া’), যিনি সেটা নিচ্ছেন, তাঁকে খুব সঙ্কটজনক অবস্থায় না পড়তে হয়। তাতে দেখা গিয়েছে, যাঁরা ওই টিকা নিয়েছিলেন, ডেঙ্গির ভাইরাস তাঁদের শরীরে কোনও ‘ছোবল’ বসাতে পারেনি। আর যাঁদের প্লেসবো ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছিল, তাঁরাও ভয়ঙ্কর জ্বরে কাবু হননি, ডেঙ্গির ভাইরাসের হানাদারিতে যেটা হয়। তাঁদের গায়ে শুধুই লাল রঙের চাকা চাকা ‘র‌্যাশ’ বেরিয়েছিল, ডেঙ্গির ভাইরাসের হানায় যা হয়। অবিকল সেই একই রকমের ‘র‌্যাশ’। যে ২০ জনকে শুধুই প্লেসবো ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১৬ জনের (৮০ শতাংশ) শরীরে ওই ‘র‌্যাশ’ বেরিয়েছিল। বাকি চার জনের (২০ শতাংশ) শরীরে শ্বেত রক্তকণিকার (ডব্লিউবিসি) সংখ্যা বেশ কিছুটা কমে গিয়েছিল, সাময়িক ভাবে।’’

আরও খবর
শার্লক হোমসের সঙ্গে কোথায় মিল ছিল আইনস্টাইনের?

ফলে, ‘ডেন-২’ ভাইরাসই আপাতত হয়ে উঠেছে ডেঙ্গি ভাইরাসের ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’!

তবে এই টিকার কি কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে?

মাধুরীর কথায়, ‘‘থাকতেই হবে। কারণ, আমরা ডেঙ্গি ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপের মধ্যে শুধুই একটিকে (ডেন-২) দিয়ে টিকা বানিয়েছি। ডেঙ্গির বাকি তিন ধরনের ভাইরাসের কার্যকরী ক্ষমতাকে সে একা কমাবে কী ভাবে! তাই এ বার আমরা ডেঙ্গির ভাইরাসের আরও একটু বেশি শক্তিশালী ‘সেরোটাইপ’- ‘ডেন-৩’ কে নিয়ে কাজ শুরু করেছি। তাকে নিয়ে বানানো টিকার পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য।’’

তবে এই টিকাই ডেঙ্গি প্রতিরোধের শেষ কথা নয়। এমনকী, তা দীর্ঘমেয়াদিও নয়। এমনটাই বলছেন ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা।


ডেঙ্গি ভাইরাসের সেরোটাইপ ডেন-৩

সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখে ‘সুইস ফেডারাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র (ইটিএইচ জুরিখ) ভাইরাস-বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘প্রথমত, এই টিকায় শুধু ডেঙ্গির ভাইরাসের বিশেষ একটি সেরোটাইপেরই হানাদারি রোখা যাবে। দ্বিতীয়ত, এই ভাইরাসগুলির জিনোমে থাকা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের (আরএনএ) খুব দ্রুত হারে ‘মিউটেশান’ হয় বলে ডেঙ্গির ভাইরাসগুলির আচার-আচরণ খুব তাড়াতাড়ি বদলে যায়। বদলে যায় তাদের চালচলন। হাবভাব। হানাদারির কায়দা-কসরৎও। তাই দু’-তিন বছর পর হয়তো দেখা যাবে ওই টিকা আর কাজে লাগছে না। তখন আবার নতুন টিকা বানাতে হবে। আর তৃতীয়ত, তার পরেও যদি অজানা কোনও হানাদার আসে, তখন তাকে রুখতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সেটাও তখন অজানাই থাকবে। তাই শুধু টিকাই ডেঙ্গি-প্রতিরোধে শেষ কথা হতে পারে না।’’

DANGUE VACCINE DISCOVERED SWISS SCIENCE PLACEBO INJECTION
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy