Advertisement
E-Paper

মুছে দেওয়া যাবে স্মৃতি, হীরক রাজার ‘যন্তরমন্তর’ এ বার বাস্তব!

স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া সোনালি দিনগুলোকে আপনি ফিরিয়ে আনতে চান? ভুলে যেতে চান ’৯২-এ বাবরি-ধ্বংসের মর্মান্তিক স্মৃতি? ভুলতে চান নেতাইয়ের এক দিনের গণহত্যার ঘটনা? আর্নল্ড শ্যোয়ার্জেনেগারের ক্লাসিক ফিল্ম ‘টোটাল রিকল’-এর নায়কের মতো কৃত্রিম স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চান গোটা সৌরজগৎ? আর চিন্তা নেই। এই সব কিছুই পারবেন!

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৩:৪৪

হীরক রাজার দেশের সেই বিজ্ঞানীরই জয়জয়কার! তাঁর ‘যন্তরমন্তর’ এ বার একেবারেই বাস্তব!

স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়া সোনালি দিনগুলোকে আপনি ফিরিয়ে আনতে চান?

ভুলে যেতে চান ’৯২-এ বাবরি-ধ্বংসের মর্মান্তিক স্মৃতি?

ভুলতে চান নেতাইয়ের এক দিনের গণহত্যার ঘটনা?

আর্নল্ড শ্যোয়ার্জেনেগারের ক্লাসিক ফিল্ম ‘টোটাল রিকল’-এর নায়কের মতো কৃত্রিম স্মৃতি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চান গোটা সৌরজগৎ?

আর চিন্তা নেই। এই সব কিছুই পারবেন! আপনার দুঃখের অবাঞ্ছিত স্মৃতিগুলোকে হয়তো এ বার মগজ থেকে পুরোপুরি মুছে দেওয়া যাবে। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’র সোনালি দিনগুলোর ফিকে হয়ে আসা স্মৃতিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলা যাবে। এমনকী, বেছে বেছে কিছু বেদনার স্মৃতি মুছে ফেলে, সেই জায়গায় কিছু কিছু সুখ-স্মৃতিকে আপনি ফিরিয়েও আনতে পারবেন! বাছাই করা কিছু সুখ-স্মৃতিকে করে তোলা যাবে আরও উজ্জ্বল।

সদ্য প্রকাশিত তিন-তিনটি যুগান্তকারী গবেষণার ফলাফল জানাচ্ছে, ‘ঈশ্বর-প্রদত্ত স্মৃতিশক্তি’ বলে কিছু নেই। কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে আমরা যেমন নতুন তথ্য দিয়ে পুরনো তথ্যকে ‘রিপ্লেস’ বা ‘ওভার-রাইট’ করতে পারি, আমাদের স্মৃতিশক্তিকেও তেমন কৃত্রিম ভাবে, আমাদের ইচ্ছেমতো ‘ডিলিট’ করতে পারা যাবে।

আমাদের মগজ নিজে থেকেই এই কাজটা করে। যেমন ই-মেলের ‘ইউসেজ স্পেস’ নির্দিষ্ট গিগাবাইট পর্যন্ত তথ্য ধরে রাখতে পারে, আমাদের মগজও তেমনই। সীমা ছাড়ালেই আমরা ‘রিফিউজ্‌ড’ হই, ই-মেলে। সে ক্ষেত্রে কোন মেল রাখব, আর কোনটা রাখব না, সেই বাছাই-বাতিলের কাজটা আমাদের করতে হয়। স্মৃতির ক্ষেত্রে ওই কাজটা করে আমাদের মগজ। এ বার কৃত্রিম ভাবে আমাদের পক্ষে সেটাও করা সম্ভব হতে পারে।

আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষক লি হুয়েই সাইয়ের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘Cell’ জার্নালে। গত জুনে ‘Nature-Neuroscience’ জার্নালে বেরিয়েছে নেদারল্যান্ডসের রাবাউন্ড ইউনিভার্সিটি নিমেজেনের জিনতাত্ত্বিক মার্টিন ক্রোয়েশের গবেষণাপত্রটি। আর হালে ‘Genome’ জার্নালে ছাপা হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোর স্ক্রিপ্‌স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জিনতত্ত্ববিদ কোর্টনি মিলারের গবেষণাপত্রটি।

নোবেলজয়ী জাপানি জিনতত্ত্ববিদ লি হুয়েই সাই।

ইঁদুরের ওপর পরীক্ষাটি করেছেন জিনতাত্ত্বিক লি হুয়েই সাই। সাইয়ের সহযোগী গবেষক নেদারল্যান্ডসের রাবাউন্ড ইউনিভার্সিটি নিমেজেনের জিনবিশারদ ঊর্মিমালা মিশ্র ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘পর পর দু’দিন একটি ইঁদুরকে প্রথমে একটি সুরেলা মিউজিক শোনানো হত। তার পরেই তাকে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক শক। বেচারা থরথর করে কেঁপে উঠত। তার পর টানা পাঁচ দিন ইঁদুরটিকে শুধুই মিউজিক শোনানো হত। পরে আর তাকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হত না। ওই পাঁচ দিনের প্রথম দু’দিন ইঁদুরটি ওই মিউজিক শুনলেই ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠত। ভাবত, এই বুঝি তাকে আবার যন্ত্রণা (শক) পেতে হবে। কিন্তু পর পর দু’দিন মিউজিক শোনার পর আর যন্ত্রণা পেতে হল না দেখে, তৃতীয়, চতুর্থ আর পঞ্চম দিনে ইঁদুরটি কিন্তু আর মিউজিক শুনে ভয়ে কাঁপল না। মানে, মিউজিক শুনলেই ভয় পেতে হয়, সেটা সে ভুলে গিয়েছে। এর পর টানা এক মাস ইঁদুরটিকে মিউজিক শুনিয়ে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে যেতে থাকলেন সাই। তার পর আর তাকে শক দেওয়া না হলেও দীর্ঘ দিন ধরে ইঁদুরটি মিউজিকটি শুনলেই ভয়ে থরথর করে কাঁপত। এটাই হল ‘ফল্‌স মেমোরি ইমপ্ল্যান্টেশান’। ভয়ের কোনও কারণ নেই, পরিবেশ নেই, তবু থরথর করে ভয়ে কাঁপছে ইঁদুর! এই জন্যই রবেন আইল্যান্ডের দীর্ঘ নির্বাসনের দিনগুলোর স্মৃতি, চাইলেও ভুলতে পারতেন না নেলসন ম্যান্ডেলা। তা যে দীর্ঘমেয়াদি ছিল। কিন্তু, নেতাইয়ের গণহত্যার ঘটনার স্মৃতি মুছে দেওয়া সম্ভব। কারণ, তা এক দিনের। বা কয়েকটা ঘণ্টার। ’’

আরও পড়ুন--তিনি না থাকলে

‘মেমোরি ডিলিশান’ বা স্মৃতি মুছে ফেলার কাজটাও দু’টি কৃত্রিম উপায়ে করা সম্ভব হয়েছে।

সেই উপায়দু’টি কী কী?

সান দিয়েগোর স্ক্রিপ্‌স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্নায়ুবিজ্ঞানী সুজাতা মুখোপাধ্যায় ই-মেলে জানিয়েছেন, ‘‘একটি উপায় হল- কৃত্রিম ভাবে এক ধরনের মাদক ‘হিস্টোন ডি-অ্যাক্টিলেজ ইনহিবিটর’ বা, ‘HDAC’ ইঁদুরের মগজে ঢুকিয়ে তার অবাঞ্ছিত ভয়ের স্মৃতি মুছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। একে বলে ‘Absolute Deletion’। আবার অবাঞ্ছিত স্মৃতিকে মুছে ফেলে তার জায়গায় কিছু কিছু ফিকে হয়ে যাওয়া সুখ-স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব হয়েছে জিন ‘TET-One’ কে আরও অনেক বেশি সক্রিয় করে তুলে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের আগে কোচ পিকে যেমন ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে ফুটবলারদের চাগিয়ে তুলতেন, তেমনই জোরালো আলো ফেলে ওই জিন ‘TET-One’ কে আরও বেশি সক্রিয় করে তুলে এই কাজটা করা হয়েছে। একে বলে-‘Selective Deletion’। কাজটি করেছেন জাপানের নোবেলজয়ী জিনতাত্ত্বিক সুশুমু তোনেগাওয়া। এ ভাবেই হয়তো ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’র সোনালি দিনের স্মৃতিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলা যাবে।

নোবেলজয়ী জাপানি জিনতাত্ত্বিক সুশুমু তোনেগাওয়া।

‘ফল্‌স মেমোরি ইমপ্ল্যান্টেশানে’র মধ্যে দিয়ে আমরা কি এক দিন পৌঁছে যেতে পারব একেবারেই কল্পনার জগতে? পৌঁছে যেতে পারব এমনকী, ‘ব্ল্যাক হোল’-এরও অন্য প্রান্তের একেবারেই অজানা-অচেনা জগতে বা ব্রহ্মাণ্ডের অন্য অন্য মাত্রায় (ডাইমেনশনে)?

জিনতাত্ত্বিক ঊর্মিমালা জানাচ্ছেন, ‘‘মস্তিষ্কে নিউরনগুলোকে ‘অ্যাক্টিভেট’ করে এখনও পর্যন্ত কয়েকটি বিশেষ ধরনের স্মৃতি কৃত্রিম ভাবে আরোপ করা সম্ভব হয়েছে। তবে রাগ, দুঃখ, ভয় ছাড়াও তো অন্য আরও অনুভূতি আমাদের স্মৃতিতে ভিড় করে থাকে। সেগুলোরও কৃত্রিম প্রতিস্থাপন সম্ভব কি না, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। আর যে পরীক্ষাগুলো ইঁদুরের ওপর সফল হয়েছে, তা মানুষের ওপর ব্যর্থ হবে, এমন কথা অন্তত জিন-তত্ত্ব বলছে না।’’

অন্তত এই কথাটাই সত্যি হোক-‘স্মৃতি সততই সুখের’!

memory false deletion implementation brain
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy