Advertisement
E-Paper

ভুতুড়ে কণার কীর্তি আবিষ্কার, ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যে নতুন আলো

নিউট্রিনো বা ভুতুড়ে কণাদের এই বিচিত্র কেরামতি দেখে তো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা! টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দিয়েছেন উৎসাহে। তাঁদের আশা, মশার হাতি নড়ানোর পথ ধরে এক দিন পৌঁছে যাওয়া যাবে বিগ ব্যাং বা সেই মহা বিস্ফোরণের ঠিক পরের সময়ে। সেই বিস্ফোরণের ঠিক পরের ৪ লক্ষ বছরে কী কী ঘটেছিল, তা তো এখনও রয়েছে পুরোপুরি অন্ধকারে।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৭ ০৯:৩০
সেই ভুতুড়ে কণা। নিউট্রিনো।- ফাইল চিত্র।

সেই ভুতুড়ে কণা। নিউট্রিনো।- ফাইল চিত্র।

আস্ত একটা ‘হাতি’কে নাড়িয়ে দিল একটা ‘মশা’! নড়িয়ে দিল। থরথর করে কাঁপিয়ে দিল। সরিয়ে দিল।

কোনও মাহুত না হলেও, এই প্রথম দেখা গেল, সেই মশাই ‘হস্তীরে নড়ান, হস্তীরে চরান’!

যা মিলিয়ে দিল ৪৩ বছর আগেকার এক বিজ্ঞানীর পূর্বাভাস।

এটুকু পড়ে বলতেই পারেন, ‘বলেন কি মশাই?’ জবাবটা হল- হ্যাঁ, মশা-ই!

মশাটা এই ব্রহ্মাণ্ডের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। যার নাম- নিউট্রিনো। যার আরও একটি নাম রয়েছে। ভুতুড়ে কণা। আর সেই হাতিটা অবশ্য আমাদের চেনা, জানা হাতি নয়। সেই হাতি আসলে একটি পদার্থের পরমাণুর ‘হৃদয়’। নিউক্লিয়াস। তবে ‘হাতি’ নিউক্লিয়াসের কাছে সেই নিউট্রিনো বা ভুতুড়ে কণা আসলে মশারই সমান!


ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া সেই ভুতুড়ে কণারা। শিল্পীর কল্পনায়।

আরও পড়ুন- পৃথিবীতে এক দিন আর কোনও গ্রহণই হবে না!

আরও পড়ুন- ‘ঈশ্বরের মন’ পড়তে পেরেছিলেন আইনস্টাইন!

নিউট্রিনো বা ভুতুড়ে কণাদের এই বিচিত্র কেরামতি দেখে তো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা! টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দিয়েছেন উৎসাহে। তাঁদের আশা, মশার হাতি নাড়ানোর পথ ধরে এক দিন পৌঁছে যাওয়া যাবে বিগ ব্যাং বা সেই মহা বিস্ফোরণের ঠিক পরের সময়ে। সেই বিস্ফোরণের ঠিক পরের ৪ লক্ষ বছরে কী কী ঘটেছিল, তা তো এখনও রয়েছে পুরোপুরি অন্ধকারে।

সেই অজানা কাহিনী কেন জানতে পারিনি?

অতীত বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা যা কিছু জানতে পারি, জানতে পেরেছি এত দিন, সে সবই ওই আলোর সূত্র ধরে। আলোর কণা ‘ফোটন’-এর হাত ধরে, তারই দেখানো পথে। ফোটনই তো এই ব্রহ্মাণ্ডকে চেনা, জানার এক ও একমাত্র ‘হাতিয়ার’ হয়েছে এত দিন। হয়ে চলেছে। ব্রহ্মাণ্ডের ‘ওয়ান অ্যান্ড ওনলি টর্চ বেয়ারার’। বিগ ব্যাং-এর পরপরই জন্ম হয়েছিল আলোর কণা ফোটনের। কিন্তু সেই ফোটনগুলি তখন নিজেদের মধ্যে ঘুষোঘুষি, খুনসুটি (স্ক্যাটারিং) করতেই ব্যস্ত ছিল। বিগ ব্যাং-এর পরের ৪ লক্ষ বছর পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে সেই ঘুষোঘুষি, খুনসুটিতে মেতে থাকার ফলে ফোটনগুলি বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ছড়িয়ে, ছিটিয়ে পড়তে পারেনি। ফলে, সেই ফোটনগুলি আমাদের সামনে টর্চের আলো ফেলতে পারেনি। তাই বিগ ব্যাং-এর পরের ৪ লক্ষ বছরে ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল, তা আমরা আজও জানতে পারিনি।

ভুতুড়ে কণারা কী জিনিস? বোঝাচ্ছেন বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী ডন লিঙ্কন। দেখুন ভিডিও। সৌজন্যে: ফের্মিল্যাব।

আর যারা সেই অজানা ঘটনাবলী জানাতে পারতো, তারা এই ভুতুড়ে কণা বা নি‌উট্রিনো। কারণ, তারাও ফোটনের সঙ্গেই জন্মেছিল বিগ ব্যাং বা সেই মহা বিস্ফোরণের পরপরই। ফোটনরা বেরিয়ে আসতে না পারলেও, বোধহয় প্রায় ‘অশরীরী’ বলেই ভুতুড়ে কণারা কিন্তু বেরিয়ে আসতে পেরেছিল বিগ ব্যাং-এর পরেই। হু হু করে চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে শুরু করেছিল। ছুটতে শুরু করেছিল উদ্দাম গতিতে। প্রায় আলোর কণা ফোটনের গতিবেগেই। এই ব্রহ্মাণ্ডে চলার পথে কোনও কণা, কোনও মহাজাগতিক বস্তুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি নিউট্রিনোদের।

তবে তারা যে আবার প্রায় ‘অশরীরী’! তাই ভুতুড়ে কণাদের ওপরেও এত দিন সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের গোপন রহস্যের জাল কাটার ব্যাপারে ততটা ভরসা করা যাচ্ছিল না।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এ বার ভুতুড়ে কণাদের এই বিচিত্র কেরামতি সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের গোপন রহস্যের জাল কেটে দিতে পারে এক দিন। জানা যেতে পারে সেই মহা বিস্ফোরণের পর কী কী ঘটনা ঘটেছিল। কারা কারা জন্মেছিল। জন্মানোর পর তারা কী করছিল। জানা যেতে পারে সেই মহা বিস্ফোরণের পিছনে কার হাত ছিল। কার ‘ইচ্ছা’য় ঘটেছিল ওই প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণ ঠিক কী ভাবে বীজ পুঁতেছিল এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির উন্মাদনার।

মুল গবেষক দিমিত্রি আকিমভ (বাঁ দিকে)। ভারতে নিউট্রিনো গবেষণার পথিকৃৎ বিজ্ঞানী নবকুমার মণ্ডল (ডান দিকে ওপরে) এবং টিআইএফআরের অধ্যাপক অমল দিঘে

তাই একটা হালকা, পলকা ভুতুড়ে কণা (খুব বেশি হলে, ইলেকট্রনের ভরের ৫ লক্ষ ভাগের মাত্র ১ ভাগ) শেষমেশ আস্ত একটা হাতিকে নাড়িয়ে দেওয়ার এই যে কেরামতি দেখাল, তা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে হয়ে গেল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। গত সাড়ে ৪ দশক ধরে যে ঘটনা চাক্ষুষ করার জন্য হাপিত্যেশ অপেক্ষায় ছিলেন বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীরা।

কোনও গল্পকথা নয়। নয় কোনও কল্পকাহিনীও। প্রায় অশরীরী ভুতুড়ে কণার এই কেরামতির কথা হালে প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ। গত ৩ অগস্ট সংখ্যায়। একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদলের ওই গবেষণাপত্রটির শিরোনাম- ‘অবজারভেশন অফ কোহেরেন্ট ইল্যাস্টিক নিউট্রিনো-নিউক্লিয়াস স্ক্যাটারিং’। মূল গবেষক মস্কোর ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ইনস্টিটিউট ফর থিয়োরেটিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের অধ্যাপক দিমিত্রি আকিমভ। গবেষকদের অন্যতম বিশিষ্ট কণাপদার্থবিজ্ঞানী জে আই কোলার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনরিকো ফের্মি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।

ভুতুড়ে কণাদের এই বিচিত্র কেরামতি চাক্ষুষ করতে গবেষকরা বানিয়ে ফেলেছেন বিশ্বের ক্ষুদ্রতম নিউট্রিনো সন্ধানী যন্ত্র বা নিউট্রিনো ডিটেক্টর। যার ওজন সাকুল্যে সাড়ে ১৪ কিলোগ্রাম বা ৩২ পাউন্ড। যা লম্বায় ৪ ইঞ্চি। চওড়ায় ১৩ ইঞ্চি।

ভুতুড়ে কণাদের চলার পথে কেউ বাধা হতে পারে না কেন?

ভারতে নিউট্রিনো গবেষণার পথিকৃৎ বিজ্ঞানী, কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের (এসআইএনপি) রাজা রামান্না ডিসটিঙ্গুইজ্‌ড ফেলো অধ্যাপক নবকুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘সে কাউকেই পরোয়া করে না বলে। কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে চায় না বলে। কথা বলতে চায় না বলে। মোদ্দা কথায়, এই ব্রহ্মাণ্ডে যেন কারও সঙ্গেই ইন্টারঅ্যাকশনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই ভুতুড়ে কণাদের।’’


সেই ভুতুড়ে কণারা।- কম্পিউটার সিম্যুলেশন।

স্ট্রং ফোর্স বা শক্তিশালী বল তো দূরের কথা, তড়িৎ-চৌম্বকীয় বল বা ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ফোর্সের সঙ্গেও কখনও কোনও বনিবনা হয় না এই ভুতুড়ে কণাদের। তাদের বনিবনা হয় শুধুই খুব দুর্বল মহাকর্ষীয় হল বা গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স আর অত্যন্ত অল্প পাল্লার উইক ফোর্স (যে বলে বাঁধা থাকে বলেই তেজস্ক্রিয় পদার্থের পরমাণু ভেঙে যায়) বা দুর্বল বলের সঙ্গে।

মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের (টিআইএফআর) অধ্যাপক অমল দিঘের কথায়, ‘‘কোনও কণা বা মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশন করাটা তাদের স্বভাবে নেই বলে এই ভুতুড়ে কণারা সব কিছুর মধ্যে দিয়েই অনায়াসে গলে যায়। তাদের ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। তাই এদের হদিশ পেতে বহু ঘাম ঝরাতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের।’’

ভুতুড়ে কণারা আমাদের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেউই টের পাচ্ছি না! কেন?

নবকুমারবাবুর বক্তব্য, এরা এতটাই ভুতুড়ে যে, প্রতি মুহূর্তে আমাদের শরীরের ১ বর্গ সেন্টিমিটারে এসে ঢুকছে ১ লক্ষ কোটি নিউট্রিনো। শরীর ফুঁড়ে সেগুলি বেরিয়েও যাচ্ছে। আমরা টেরও পাচ্ছি না। এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই প্রতি ১ ঘন সেন্টিমিটারে থাকে ৪৩০টি ফোটন। আর নিউট্রিনো কণা থাকে ৩১০টি। নিউট্রিনোরা আদতে ইলেকট্রনের মতোই মৌল কণা। তাদের আর ভাঙা যায় না। তবে ইলেকট্রনের যেমন আধান (চার্জ) রয়েছে, এদের তা নেই। নিউট্রিনোরা একেবারে শ্রীনিরপেক্ষ! ’৬০-এর দশকের শেষাশেষি প্রথম জানা যায়, এরা তিন ধরনের হয়। মানে, তাদের তিন ধরনের ‘ফ্লেভার’ থাকে। ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউওন নিউট্রিনো আর টাওন নিউট্রিনো। এও জানা গিয়েছে, ব্রহ্মাণ্ডে নিজেদের যাত্রাপথে এরা ‘বহুরূপী’ হয়। এক রূপ থেকে ঘন ঘন বদলে যায় অন্য রূপে। ইলেকট্রন নিউট্রিনো বদলে যায় মিউওন নিউট্রিনো বা টাওন নিউট্রিনোয়। আর ’৯৮ সালে প্রথম জানা যায়, এদের ভরও রয়েছে খুব সামান্যই। তবে তা কত, এখনও ঠিকঠাক ভাবে তা জানা সম্ভব হয়নি।

অতলান্ত ব্রহ্মাণ্ড সাঁতরাতে গিয়ে যে ভাবে রং, রূপ (ফ্লেভার) বদলায় ‘বহুরূপী’ ভুতুড়ে কণারা

ভুতুড়ে কণাদের বিচিত্র কেরামতি চাক্ষুষ করতে কেন লাগল সাড়ে ৪ দশক?

একটা গল্প বলা যাক। মনে করুন, একটা ক্যাফেটারিয়া। তার ভেতরে চা, কফি, পকোড়া নিয়ে এখানে ওখানে জটলা। সেই ক্যাফেটারিয়ার একটা দরজা দিয়ে হুশ্ করে ঢুকে একটা লোক অন্য দরজা দিয়ে হুশ্ করে বেরিয়ে গেল। চোখের নিমেষে। কোনও জটলার কারও সঙ্গে কথা বলল না। কোথাও দু’দণ্ড দাঁড়াল না। সবাই গল্পে মজে রয়েছে বলে কোনও জটলারই কেউ তাকে খেয়ালও করতে পারল না। এই নিউট্রিনোরাও তেমনই ব্রহ্মাণ্ডে প্রায় কারও সঙ্গেই তেমন ‘গল্প’ করতে চায় না বলে নিউট্রিনোদের দেখা বা তাদের বিচিত্র কেরামতি চাক্ষুষ করাটা খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। তবু ১৯৫৬ সালে প্রথম এরা ধরা দিয়েছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা কয়েকটি প্রোটন বা নিউট্রনকে ধাক্কা মেরে ছিটকে দিয়েই প্রথম ধরা পড়েছিল এই ভুতুড়ে কণারা। কিন্তু আস্ত একটা ভারী নিউক্লিয়াসটাকেই যে ধাক্কা মেরে সরাতে পারে, ভুতুড়ে কণাদের সেই বিচিত্র কেরামতি এত দিন চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের।

আরও পড়ুন- ওজন আধুলির মতো! পৃথিবীকে পাক মারছে ৬ মহাকাশযান

অধ্যাপক নবকুমার মণ্ডল জানাচ্ছেন, এই নিউট্রিনোরা আসলে লো এনার্জির ভুতুড়ে কণা। তারা প্রায় অশরীরী বলে অসম্ভব রকমের হালকা, পলকা তো বটেই, তাদের দমও খুব কম। শক্তি কম। ফলে, তারা যখন তাদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ ভারী নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মারে, তখন সেই ধাক্কা ততটা জোরালো হতে পারে না যাতে নিউক্লিয়াসটা যে সরছে বা দুলছে, তা সহজে বোঝা যায়। যে ধাক্কা মারছে তার কিছুটা শক্তি তো যাকে ধাক্কা মারছে, তার কাছে চলে যাবেই। তখন যে ধাক্কা খেল, সে ওই অল্প শক্তিতে নড়ে, দুলে ওঠে। তার নিজের জায়গা থেকে একটু সরে যায়। এ বার সেটাই হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই প্রথম হাতেকলমে প্রমাণ পেলেন, প্রায় অশরীরী ভুতুড়ে কণারা হাতির চেহারার মতো বিশাল নিউক্লিয়াসকেও নাড়িয়ে দিতে পারে, তার জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে পারে।

ভুতুড়ে কণা আর ইলেকট্রনের মতো লেপটন কণাদের ফারাকটা কোথায়? দেখুন অ্যানিমেশন ভিডিও।

অধ্যাপক অমল দিঘের বক্তব্য, যেহেতু লো এনার্জির নিউট্রিনোদের দেওয়া ধাক্কাটা ততটা জোরালো নয়, তাই তাদের ধাক্কায় পরমাণুর ভারী নিউক্লিয়াসটা এতটাই সামান্য নড়ে বা সরে যে, তাকে চাক্ষুষ করতে গেলে যে ডিটেক্টর লাগে, তার সেনসেটিভিটি অনেক অনেক গুণ বাড়ানোর দরকার হয়। সেটা এত দিন আমাদের হাতে ছিল না বলেই ভুতুড়ে কণাদের এই বিচিত্র কেরামতি চাক্ষুষ করতে লেগে গেল প্রায় সাড়ে ৪ দশক। এ বার গবেষকরা সেই ডিটেক্টরের সেনসেটি‌ভিটি তো অনেক অনেক গুণ বাড়িয়েছেনই, সেই যন্ত্রকে কিছুটা পোর্টেবলও করে ফেলেছেন।

আবার সেই ক্যাফেটারিয়ার গল্পে ফিরি। যে লোকটা হুশ্ করে ঢুকে নিঃসাড়ে হুশ্ করে বেরিয়ে গেল ক্যাফেটারিয়ার অন্য দরজা দিয়ে, সে তো ক্যাফেটারিয়ার ভেতরে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জটলাগুলোর ভিড়ে মিশে গিয়ে দু’দণ্ড কথা বলার ফুরসৎই পাবে না। তার তো খুব তাড়া। তাড়ার চোটে সে বড়জোর জটলার দু’-এক জনকে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে যাবে। তার ধাক্কায় কেউ জটলা থেকে সামান্য ছিটকেও যেতে পারে।

কিন্তু যে লোকটার দম কম, তাড়া কম, সে ক্যাফেটারিয়ায় পছন্দ মতো কোনও জটলায় গিয়ে গল্পে মশগুল হওয়ার সুযোগটা বেশি পাবে। সময়ও বেশি পাবে। সময়টা তার হাতে একটু বেশি বলে সে জটলার মধ্যে ঢুকে সবার সঙ্গেই ভাব জমাতে চাইবে। গোটা জটলাটাকেই নাড়াবে, জমাবে!

এ বার সেই ঘটনাটাই ঘটেছে।


প্রথম যখন জানা গেল খুব সামান্য হলেও ভর রয়েছে ভুতুড়ে কণাদের। ১৯৯৮-এ

নবকুমার বাবু বলছেন, ‘‘বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লো এনার্জির নিউট্রিনোদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনাই ঘটছে। এত দিন বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লো এনার্জির নিউট্রিনোরা শুধুই তাদের চলার পথে পড়া নিউক্লিয়াসের কয়েকটা প্রোটন, নিউট্রনকে ধাক্কা মেরে ছিটকে দিতে পারে। এ বার দেখা গেল, শুধু তাই নয়। লো এনার্জির ভুতুড়ে কণারা গোটা হাতিটাকেই, মানে পরমাণুর নিউক্লিয়াসটাকেই সরিয়ে দেয় কিছুটা। নড়িয়ে দেয়, দুলিয়ে দেয়।’’

নবকুমারবাবু ও অমল দিঘের বক্তব্য, যেটা আরও তাৎপর্যের, তা হল, এ বার এটাও দেখা গিয়েছে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মেরে তার ভেতর থেকে প্রোটন, নিউট্রনকে ছিটকে বের করে দেওয়ার যতটা সম্ভাবনা, লো এনার্জির ভুতুড়ে কণা বা নিউট্রিনোদের ধাক্কায় নিউক্লিয়াসের দুলে ওঠা বা সরে যাওয়ার সম্ভাবনা তার চেয়ে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি।

কোন পদার্থের পরমাণুর ভারী নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে পেরেছে ভুতুড়ে কণারা?

আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের জবাবে মূল গবেষক, মস্কোর ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ইনস্টিটিউট ফর থিয়োরেটিক্যাল অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের অধ্যাপক দিমিত্রি আকিমভ ই-মেলে লিখেছেন, ‘‘দু’টি মৌলিক পদার্থ সিজিয়াম ও আয়োডিনের একটি যৌগ সিজিয়াম আয়োডাইডের পরমাণু নিয়ে আমরা পরীক্ষাটা চালিয়েছি। এই পরমাণুর নিউক্লিয়াসকেই সরাতে, নড়াতে, দোলাতে পেরেছে নিউট্রিনোরা। এ বার আমরা দেখব, আরও দু’টি মৌলিক পদার্থ জেনন ও জার্মেনিয়ামের পরমাণুর নিউক্লিয়াসকেও লো এনার্জির নিউট্রিনোরা নাড়াতে পারে কি না।’’

এই আবিষ্কার আগামী দিনে কোন কোন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল?

নবকুমারবাবুর বক্তব্য, এর ফলে তিনটি সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল। এক, এর ফলে কোন কোন কণাগুলি ডার্ক ম্যাটার, তার অনুসন্ধানের কাজটা সহজ হবে। দুই, তারাদের মৃত্যুর পর যে বিস্ফোরণ হয়, সেই সুপারনোভা থেকে বেরিয়ে আসা নিউট্রিনোদের খোঁজ পাওয়ার ক্ষেত্রেও এ বার কিছুটা সুবিধা হতে পারে। তিন, পৃথিবীর কোথায় কোথায় অস্ত্র বানানোর লক্ষ্যে পরমাণু চুল্লি বা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর গোপনে বানানো হচ্ছে বা চালু রয়েছে, তার হালহদিশ জানার উপায় বাতলে দিতে পারে এই আবিষ্কার। যে প্রযুক্তিতে এই আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে, তা অভিনব। প্রযুক্তির অভাবে ভারতে মূলত বায়ুমণ্ডলের হাই এনার্জির নিউট্রিনোদের নিয়েই গবেষণা হয়েছে এত দিন। এখনও হচ্ছে। লো এনার্জির নিউট্রিনোদের নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এ দেশে এখনও পর্যন্ত হয়নি।

হালকা, পলকা ভুতুড়ে কণারা যে সৃষ্টির আদি কাল থেকেই খেলে যাচ্ছে হাতি’ নাড়ানোর ‘মাদারিকা খেল’, এই সে দিন আমরা তা দেখতে পেলাম!

প্রায় ১৪০০ কোটি বছর ধরেই যে আমাদের চোখে ধুলো গিয়ে চলছিল এই ভুতুড়ে কণারা!

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: ফের্মিল্যাব, আমেরিকা

Nutrino Ghost Particle Neutrino-Nucleus Collision COHERENT কোহেরেন্ট ফ্রিডম্যান নিউট্রিনো
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy