Advertisement
E-Paper

হাজার হাজার আলোর উজ্জ্বলতম ঝাড়বাতির হদিশ মিলল ব্রহ্মাণ্ডে!

হাজার হাজার আলোর ‘ঝাড়বাতি’র খোঁজ মিলল মহাকাশে! এত উজ্জ্বল ‘ঝাড়বাতি’ এর আগে আর দেখা যায়নি এই ব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও, অন্য কোনওখানে! জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ‘মহাজাগতিক ঝাড়বাতি’কে বলে ‘পালসার’।

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৭ ১০:৩১
এই ব্রহ্মাণ্ডের উজ্জ্বলতম পালসার।

এই ব্রহ্মাণ্ডের উজ্জ্বলতম পালসার।

হাজার হাজার আলোর ‘ঝাড়বাতি’র খোঁজ মিলল মহাকাশে! এত উজ্জ্বল ‘ঝাড়বাতি’ এর আগে আর দেখা যায়নি এই ব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও, অন্য কোনওখানে!

জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ‘মহাজাগতিক ঝাড়বাতি’কে বলে ‘পালসার’। এত উজ্জ্বল পালসারের হদিশ এর আগে মেলেনি ব্রহ্মাণ্ডে। ‘হাজার বাতির আলো’য় তা রীতিমতো ঝকঝকে আলো ছড়াচ্ছে মহাকাশে। যেন ‘হাজার হাজার আলোর ঝাড়বাতি’! আর তার খোঁজ মিলল এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রথম পালসার আবিষ্কারের (১৯৬৭) ঠিক ৫০ বছরের মাথায়।

কতটা উজ্জ্বল সেই ‘ঝাড়বাতি’, জানেন?

এক সেকেন্ডে যতটা আলো উগরোয় এই ‘মহাজাগতিক ঝাড়বাতি’, সেই পরিমাণ আলো আর শক্তি আমাদের সূর্য উগরোয় পাক্কা সাড়ে তিনটি বছর ধরে। তা হলেই বুঝুন, কী বিপুল পরিমাণ আলো উগরে দিচ্ছে ওই সদ্য আবিষ্কৃত পালসারটি। যার নাম- ‘এনজিসি-৫৯০৭-ইউএলএক্স’। নাসার ‘নিউস্টার’ (‘নিউক্লিয়ার স্পেকট্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ অ্যারে’) টেলিস্কোপের চোখেই ধরা পড়েছে এই হাজার আলোর ঝাড়বাতিটা। খুব সম্প্রতি। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইএসএ বা ‘এসা’) ‘এক্সএমএম-নিউটন’ উপগ্রহের চোখেও ধরা পড়েছে এই পালসারটি। এই হাজার হাজার আলোর ‘ঝাড়বাতি’টা রয়েছে আমাদের থেকে ৫০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। তার মানে, পৃথিবীতে মানুষ বা তার আদিপুরুষের জন্মের আগেই জন্ম হয়েছিল এই বিরল পালসারটির। যা আদতে একটি নিউট্রন স্টারও বটে। মঙ্গলবার এই সাড়াজাগানো গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ। ওই আন্তর্জাতিক গবেষকদলে রয়েছেন এক জন বাঙালি সহযোগী গবেষকও। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘এসা’র উপগ্রহের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণের পর সংশ্লিষ্ট আরও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটার্স’-এ।


নাসার ‘নিউস্টার’ টেলিস্কোপে ধরা পড়া সেই উজ্জ্বলতম পালসার

পালসার কী? এই আবিষ্কারের অভিনবত্ব কোথায়?

মূল গবেষক ইতালির ‘আইএনএএফ-অসারভেটরিও অ্যাস্ট্রোনমিক্যা দ্য রোমা’-র জ্যোতির্বিজ্ঞানী গিয়ান লুকা ইজরায়েল আনন্দবাজারের পাঠানো প্রশ্নের ই-মেল জবাবে লিখেছেন, ‘‘সূর্যের মতো কোনও নক্ষত্র বা তারা মৃত্যুপথযাত্রী হলে তাদের দু’রকম অবস্থা হতে পারে। হয় তারা ব্ল্যাক হোল হয়ে যায়। আর তা না হলে তারা হয়ে পড়ে নিউট্রন স্টার বা নিউট্রন নক্ষত্র। পালসার তেমনই একটি নিউট্রন নক্ষত্র। যার চার পাশের চৌম্বক ক্ষেত্রটি অসম্ভব রকমের জোরালো। আর সেই নিউট্রন নক্ষত্রটা একেবারে লাট্টুর মতো বনবন করে ঘুরছে। পালসার থেকে আলোর বিকিরণ বেরিয়ে আসে দু’টি তীব্র উজ্জ্বল আলোর স্রোতে। অনেকটা ধূমকেতুর পুচ্ছের মতো তা ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে।’’

আরও পড়ুন- এই ভারতীয় না থাকলে নতুন ৭ ‘পৃথিবী’র হদিশ মিলত কি?​

কী ভাবে জন্ম হল এই পালসারটির?


ব্রহ্মাণ্ডে যে- মুলুকে খোঁজ মিলল ওই ‘হাজার হাজার আলোর ঝাড়বাতি’র

সান ডিয়েগো থেকে টেলিফোনে সহযোগী গবেষক, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এই পালসারটির আবিষ্কার ব্রহ্মাণ্ডে উজ্জ্বলতম পালসারের ইতিহাসে একটি নতুন রেকর্ড গড়ল। এর আগে ব্রহ্মাণ্ডের উজ্জ্বলতম পালসারটি ছিল ‘এম-৮২-এক্স-২’। যা রয়েছে আমাদের থেকে অনেক অনেক দূরে, এক কোটি ২০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্বে। আর সেটি রয়েছে ‘সিগার গ্যালাক্সি’- ‘মেসিয়ার-৮২’-তে। সদ্য আবিষ্কৃত পালসারটি আগেরটির চেয়ে ১০ গুণ বেশি উজ্জ্বল। শুধু তাই নয়, কোনও নিউট্রন নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য যতটা হতে পারে বলে এত দিন মনে করতেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা, এই সদ্য আবিষ্কৃত পালসারটির ঔজ্জ্বল্য তার অন্তত ১ হাজার গুণ। এই আবিষ্কার আমাদের পালসার ও নিউট্রন নক্ষত্র সম্পর্কে যাবতীয় ধ্যানধারণা বদলে দিয়েছে। এমনকী, দশটা সূর্য শেষ হয়ে গিয়ে যে ব্ল্যাক হোল তৈরি করে, তার অ্যাক্রিশন ডিস্ক থেকে যতটা আলো ঠিকরে বেরিয়ে আসে, এই পালসারের ঔজ্জ্বল্যতা তার ১০ গুণেরও বেশি। তবে এত ঔজ্জ্বল্য কী ভাবে পেল ওই সদ্য আবিষ্কৃত পালসারটি, তা আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। এটা আমাদের কাছে এখনও রহস্যাবৃতই রয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ওই পালসারের চৌম্বক ক্ষেত্রটি অসম্ভব রকমের জোরালো। নিউট্রন নক্ষত্রের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে যে মহাজাগতিক বস্তুগুলি ধেয়ে আসছে ওই নক্ষত্রটির দিকে, নক্ষত্রের অসম্ভব জোরালো চৌম্বক ক্ষেত্র তাকে মহাকাশে নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে।’’

পাওয়া গেল প্রথম ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ পালসার’ও


সদ্য আবিষ্কৃত ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম কোনও ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ পালসার’। নাম যার ‘এআর-স্করপি’।

পালসার আবিষ্কারের ৫০ বছরের মাথায় ঘটল আরও একটি বিরলতম ঘটনা। চলতি বছরের গোড়ায় হদিশ মিলল ব্রহ্মাণ্ডে প্রথম কোনও ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ পালসার’-এর।যার নাম- ‘এআর-স্করপি’। যা রয়েছে আমাদের থেকে ৩৮০ আলোকবর্য দূরে। ‘স্করপিয়াস’ নক্ষত্রপুঞ্জে। যে সাদা বামন নক্ষত্রটি থেকে এই পালসারটির জন্ম, তার আকার আমাদের পৃথিবীর মতো হলেও ভরে তা আমাদের গ্রহের প্রায় ২ লক্ষ গুণ বেশি। সাড়ে তিন ঘণ্টায় ওই পালসারটি পাক মারছে তার ঠাণ্ডা নক্ষত্রটিকে। সাউথ আফ্রিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজার্ভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড বাকলে ও ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল এই পালসারটি আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার-অ্যাস্ট্রোনমি’ জার্নালে।

এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কতটা?

ভারতের ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ উপগ্রহের সায়েন্স অপারেশনের প্রধান, পুণের ‘আয়ুকা’র জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘এটা নিঃসন্দেহে একটা অভিনব আবিষ্কার। কারণ, ১৯৬৭ সালে প্রথম পালসার আবিষ্কারের পর থেকেই তত্বগত ভাবে এমন পালসারের অস্তিত্বের মোটামুটি একটা ধারণা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। কিন্তু এমন পালসারের খোঁজ মিলছিল না কিছুতেই। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ঘোরে যে ‘ক্র্যাব পালসার’ (এক সেকেন্ডে ৩০ বার), তার সন্ধান পাওয়ার পর মনে হয়েছিল, ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ পালসার’ বোধহয় কল্পনাই। এই আবিষ্কার সেই অর্থে, প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়া জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বুকে বল-ভরসা জোগালো। কারণ, ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ পালসার’ অত জোরে ঘুরতে পারে না। আমার মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে এমন আরও ‘হোয়াইট ডোয়ার্ফ পালসার’-এর খোঁজ মিলবে ব্রহ্মাণ্ডে।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

Brightest Pulsar Universe Milky Way Galaxy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy