Advertisement
E-Paper

মাদার টেরিজা ঈশ্বরের এক প্রিয় মানুষ

কলকাতার আর্চবিশপ’স হাউসের ফিনান্সিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ফাদার মলয় বি ডি’কস্টা-র মুখোমুখি ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়।কলকাতার আর্চবিশপ’স হাউসের ফিনান্সিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ফাদার মলয় বি ডি’কস্টা-র মুখোমুখি ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৪৯
মাদারের সঙ্গে ফাদার মলয় ডি’কস্টা।

মাদারের সঙ্গে ফাদার মলয় ডি’কস্টা।

প্রশ্ন: মাদার টেরিজা এ বার থেকে সন্ত টেরিজা। কী ফারাক হল?

ফাদার: অনেক ফারাক হয়ে গেল। এখন থেকে ঈশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা, আমাদের মনের কথা পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেল। আমরা এমন এক জনকে পেলাম, যিনি ঈশ্বরের আরও কাছের। ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদধন্য। ঈশ্বরের নির্বাচিত এক জন মানুষ। আমরা তাঁর কাছেই প্রার্থনা জানাতে পারব। তিনি সরাসরি পৌঁছে দেবেন ঈশ্বরের কাছে।

আরও খবর- মানবতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন মাদার

প্রশ্ন: ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা তো সরাসরি যে কোনও মানুষ জানাতে পারেন। তার জন্য তো সন্তের দরকার হয় না।

ফাদার: একটা পরিবারে যদি আমরা অনেকে থাকি, তা হলে আমরা দেখি পরিবারের প্রধান অর্থাৎ বাবা অথবা মায়ের কাছে পরিবারের কোনও এক জন বা কয়েক জন নিজের গুণেই বেশি প্রিয় হন। বাবা অথবা মায়ের কাছে বা পরিবারের প্রধানের কাছ থেকে কোনও একটা দাবি যখন আমরা আদায় করতে পারি না, তখন বাবা বা মায়ের সেই প্রিয় মানুষটার দ্বারস্থ হই। তিনি যদি আমার হয়ে বাবা বা মাকে বলেন, তা হলে তাঁরা রাজি হয়ে যান। টেরিজা ঈশ্বরের কাছে তেমনই এক প্রিয় মানুষ। তিনি আমাদের হয়ে বললে, ঈশ্বর অবশ্যই তা পূরণ করবেন।

আরও খবর- আস্তাকুঁড় থেকে ককপিটে মাদারের শিশু

প্রশ্ন: মাদার টেরিজা তো প্রথম সন্ত নন। আরও অনেককেই তো ভ্যাটিকান এর আগে সন্ত ঘোষিত করেছে। তাঁদের কাছেও তো প্রার্থনা করার সুযোগ ছিল।

ফাদার: হ্যাঁ, ঠিকই। আরও অনেকেই আগে সন্ত হয়েছেন। কিন্তু মাদার তো আমাদের নিজেদের মানুষ ছিলেন। একটা মানুষ, যাঁকে আমরা চোখের সামনে চলতে ফিরতে দেখেছি, তাঁর স্পর্শ পেয়েছি, তিনিই সন্ত ঘোষিত হচ্ছেন। যে মানুষটাকে বেশ কাছ থেকে চিনতাম, নিজের জীবদ্দশাতেই দেখে যাচ্ছি, তিনি সন্ত হয়ে গেলেন। এ এক অভূতপূর্ব অভি়জ্ঞতা। পরিচিত সেই মানুষটার কাছে নিজেদের প্রার্থনা তুলে ধরা অনেক সহজ।

আরও খবর- ‘মেমোরিজ অব মাদার টেরিজা’

প্রশ্ন: মাদারের সঙ্গে কোনও বিশেষ স্মৃতির কথা উল্লেখ করবেন?

ফাদার: ২১ বছর আগের একটা ঘটনা বলি। তখন আমি প্রিস্ট অর্থাৎ পুরোহিত হলাম। তার তিন দিনের মাথায় মাদার হাউসে এক প্রার্থনায় অংশ নিতে গেলাম। তখন তো এই রকম ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। ফিল্ম লাগানো ক্যামেরা ছিল। প্রিস্ট হওয়ার পর মাদার হাউজে গিয়ে যে প্রার্থনায় অংশ নিলাম, ওই ক্যামেরাতেই তার ছবি তোলা হয়েছিল। পরে দেখা গেল, ক্যামেরায় ফিল্মের রোলটা ঠিক মতো লাগেনি। ফলে একটাও ছবি ওঠেনি। আমি পরে এক দিন মাদারকে বললাম, সে দিন যে আপনার সঙ্গে প্রার্থনায় অংশ নিলাম, তার একটাও ছবি ওঠেনি। মাদার একটু হেসে আমাকে বললেন, আসলে যিশু চান, তুমি আরও এক বার আমার এখানে এসে প্রার্থনায় অংশ নাও।

আরও খবর- কলকাতায় মাদারের এক্সক্লুসিভ ছবি

প্রশ্ন: অসামান্য একটা স্মৃতি! সেই মানুষটা যখন আজ সন্ত ঘোষিত হচ্ছেন, তখন আপনাদের অনুভূতিটা ঠিক কেমন?

ফাদার: এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা একটু শক্ত। যাঁকে এত কাছ থেকে জানতাম, আমাদের মধ্যেই যে মানুষটা ছিলেন, আজ জানতে পারছি, তিনি সাধারণ কেউ ছিলেন না, তিনি সন্ত ছিলেন! নিজেদেরকেও সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তবে একটা কথা বলি, মাদার টেরিজা সন্ত হিসেবে ঘোষিত না হলেও, তিনি কিন্তু আমাদের চোখে সাধারণের চেয়ে অনেক উপরে ছিলেন। তাঁকে ‘লিভিং সেন্ট’ বলা হত। অর্থাৎ, জীবদ্দশাতে তো কাউকে সন্ত ঘোষণা করা হয় না। মরণোত্তরই এই ঘোষণা হয়। আমরা কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতেই চিনে গিয়েছিলাম যে তিনি সন্ত।

আরও খবর- ও আলোর পথযাত্রী...

প্রশ্ন: আগে কাউকে সন্ত ঘোষিত হতে দেখেছেন?

ফাদার: হ্যাঁ, দেখেছি। কিন্তু তাঁদের কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য সে ভাবে হয়নি। ভারত থেকে এর আগে সন্ত হয়েছেন মাত্র তিন জন। দু’জন কেরল থেকে, এক জন গোয়া থেকে। তাঁদের তো আমরা দেখিনি। দেখেছি পোপ দ্বিতীয় জন পলকে। মৃত্যুর পর তিনিও সন্ত ঘোষিত হয়েছেন। তিনি কলকাতায় এসেছিলেন, তাঁকে দেখেছিলাম। মাদারকে আরও অনেক কাছ থেকে দেখেছি। মাদারের দেওয়া ক্রস আজও আমার কাছে থাকে।

আরও খবর- শান্ত, সমাহিত মাদার হাউস মগ্ন দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে

প্রশ্ন: প্রথমে বিয়েটিফিকেশন, তারপর ক্যাননাইজেশন। এই প্রক্রিয়া ঠিক কী?

ফাদার: সন্ত হওয়ার পথে বিয়েটিফিকেশন হল প্রথম ধাপ। যাঁকে সন্ত ঘোষণা করা উচিত বলে মানুষ মনে করছেন, তিনি যে সব এলাকায় কাজ করেছেন, সেখান থেকেই প্রস্তাবটা যায়। এক প্রার্থনা বা খ্রিস্টজাগের মধ্য দিয়ে সে প্রস্তাব প্রথম উত্থাপিত হয়। স্থানীয় বিশপ বা আর্চবিশপই সেই প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেন। তার পর ভ্যাটিকানে সেই প্রস্তাব পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন: ভ্যাটিকানে প্রস্তাব পাঠালেই কি তা গ্রাহ্য হয়?

ফাদার: না, তা হয় না। যাঁকে সন্ত ঘোষণা করার প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে, তিনি যে অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন, তা প্রমাণ করতে হয়। বিশপ যে প্রস্তাব পাঠান, তার সঙ্গে অন্তত একটি অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাঠাতে হয়।

আরও খবর- তিলোত্তমার মাদার

প্রশ্ন: তার পর?

ফাদার: তার পর ভ্যাটিকান খতিয়ে দেখে, যে অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, তা সত্য কি না। ভ্যাটিকান তদন্ত করে। যখন প্রমাণিত হয় যে সত্যিই ওই অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, তখন বিয়েটিফিকেশন হয়। অর্থাৎ, যাঁকে সন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাঁকে পোপ ‘ব্লেসেড’ ঘোষণা করেন। ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় এক ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে পোপ ঘোষণা করেন, তিনি ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদে ধন্য ছিলেন। ঈশ্বরের কাছের ছিলেন।

আরও খবর- ফিরে দেখা: মাদারের মহাপ্রয়াণ

প্রশ্ন: এর পর ক্যাননাইজেশন কী ভাবে হয়?

ফাদার: ক্যাননাইজেশন সচরাচর এত তাড়াতাড়ি হয় না। টেরিজার প্রয়াণ ১৯৯৭ সালে। ২০০৩ সালের মধ্যেই তিনি ‘ব্লেসেড’ ঘোষিত হয়েছেন। তার ১৩ বছরের মধ্যেই ক্যাননাইজেশন হচ্ছে। অর্থাৎ সন্ত ঘোষিত হচ্ছেন। এ ঘটনা বেশ বিরল।

প্রশ্ন: কিন্তু ক্যাননাইজেশন প্রক্রিয়াটা কেমন?

ফাদার: ক্যাননাইজেশন প্রক্রিয়ায় এখানকার চার্চের কোনও ভূমিকা নেই। এখান থেকে প্রস্তাব গিয়েছিল। অলৌকিক ক্ষমতার নমুনা তুলে ধরা হয়েছিল। তার ভিত্তিতে মাদার টেরিজা ব্লেসেড টেরিজা হয়ে গিয়েছেন। তার পর থেকে পুরো প্রক্রিয়াটাই ভ্যাটিকানের নিয়ন্ত্রণে। অলৌকিক শক্তির একটি নমুনার ভিত্তিতে বিয়েটিফিকেশন হয়। তার পর অন্তত আরও একটি অলৌকিক ঘটনার সন্ধান পাওয়ার দরকার হয়, যা তাঁর অলৌকিকতার পরিচায়ক হিসেবে উঠে আসবে আরও এক বার। সেই অলৌকিক ঘটনাটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব ভ্যাটিকানের। যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে ব্লেসেড থেকে সেন্টহুডে উত্তরণ। যদি না পাওয়া যায়, তা হলে ব্লেসেড হয়েই থেকে যাওয়া। ব্লেসেড টেরিজার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অলৌকিকের সন্ধানটা ভ্যাটিকান দ্রুতই পেয়ে গিয়েছে। টেরিজার কৃপায় ব্রাজিলে এক জনের অলৌকিক রোগমুক্তির ঘটনা সামনে আসার পর ভ্যাটিকান সিদ্ধান্ত নিয়েছে, টেরিজাকে সন্ত ঘোষণা করা হবে।

আরও খবর- বিপন্ন বিস্ময়

প্রশ্ন: কিন্তু মাদার টেরিজা ব্লেসে়ড টেরিজা হয়েছিলেন যে ঘটনার উপর ভিত্তি করে, তা নিয়ে তো যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মনিকা বেসরার সেরে ওঠায় মাদারের কোনও কৃতিত্ব নেই বলে কয়েক জন চিকিৎসক দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি, মনিকার ক্যান্সার হয়নি। পেটে সিস্ট হয়েছিল। অপারেশন করে তা বাদ দিয়ে তাঁকে সুস্থ করা হয়েছে। অলৌকিক উপায়ে মনিকা নাকি সুস্থ হননি।

ফাদার: মনিকা বেসরা নিজে কী বলছেন? তিনি তো বলছেন, তিনি টেরিজার কৃপাতেই অলৌকিক আরোগ্য পেয়েছেন। এর পর আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে? আর যে চিকিৎসকেরা বলছেন, অলৌকিক আরোগ্য নয়, তাঁদের কথা তো ভ্যাটিকানের প্রতিনিধিরা বার বার শুনতে চেয়েছিলেন। তাঁরাই তো এলেন না।

প্রশ্ন: সেন্ট টেরিজার কাছে কী প্রার্থনা করবেন?

ফাদার: তিনি নিজে সারা জীবন গোটা মানবজাতির কল্যাণ চেয়ে গিয়েছেন। অতএব সকলের কল্যাণই চাইব। ৫ সেপ্টেম্বর মাদার হাউসে বিশেষ প্রার্থনা হবে। সেখানেই নিজের প্রার্থনা তুলে ধরব।

mother teresa
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy