Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ

ব্রাজিল বিদায় যুবভারতীতে

ম্যাচ শেষে দেখা গেল ব্রাজিলের পাওলিনহো, লিঙ্কন-রা অনেকেই মাটিতে শুয়ে। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। কেউ মুখ ঢাকছে ব্যর্থতায়। কিন্তু কে তাকাবে তাদের দিকে?

সহমর্মী: পাওলিনহোকে সান্ত্বনা ইংল্যান্ড ফুটবলারের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

সহমর্মী: পাওলিনহোকে সান্ত্বনা ইংল্যান্ড ফুটবলারের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৭ ০৪:২০
Share: Save:

ইংল্যান্ড-৩ : ব্রাজিল-১

এ দৃশ্য কখনও দেখেনি যুবভারতী।

হতাশা এবং নিস্তব্ধতার মিশেলের ছবি কি এ রকমই হয়?

ম্যাচ শেষে দেখা গেল ব্রাজিলের পাওলিনহো, লিঙ্কন-রা অনেকেই মাটিতে শুয়ে। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। কেউ মুখ ঢাকছে ব্যর্থতায়। কিন্তু কে তাকাবে তাদের দিকে?

কলকাতার তো আজ শোকের দিন। ভেঙে পড়ার প্রহর। ব্যর্থ নায়কদের কান্না তাই শহরের ব্রাজিল সমর্থকদের মন ছুঁতে পারে না। বরং ব্রাজিলের হারে দ্রুতই মাঠ ফাঁকা হয়ে গেল। কলকাতা ডার্বি হলে দু’দলের এক দল আনন্দ করে, অন্যরা শোকার্ত হয়। কারও স্বপ্ন সফল হয়, কারও হয় না। এটাই এতদিন দেখা।

কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় যে কোনও বিভেদ ছিল না গ্যালারিতে। কয়েক হাজার হলুদ পতাকার প্রতিপক্ষ ছিল হাতে গোনা ইংল্যান্ডের কয়েকটি পতাকা। পুরো শহরও তো চেয়েছিল আর একটা সাম্বা-ঝলক। আর একটা জার্মান-ম্যাচের উত্তেজনা পোহাতে। ব্রিটিশ-বধ দেখার অপেক্ষাতেই তো মাঠ ভর্তি করে আসা! না হলে রাত জেগে টিকিট ‘বুক’ করে, লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে কে আর এত কষ্ট করে ম্যাচ দেখতে আসে।

আরও পড়ুন: গতিতেই শেষ করেছি, বলে দিচ্ছেন ব্রিটিশ কোচ

বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সাম্বা সমর্থকদের স্তব্ধ করে দেওয়া ইংল্যান্ডের নায়ক রিয়ান ব্রিউস্টারের উপর ম্যাচ শেষে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাঁর সতীর্থরা। প্রায় ফাঁকা স্টেডিয়ামে পিরামিডের মতো দেখাচ্ছিল সেটা।

নয় বছর আগে স্টেডিয়ামের ঠিক ওই জায়গায় গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে বুকে চাপড় মেরে নিজেকে চিনিয়েছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। যা ফুটবল রাজপুত্রের নিজস্ব স্টাইল। সেই ‘মারাদোনা সেলিব্রেশন’ যে সঞ্চারিত হয়েছে লিভারপুলের একটা বাচ্চা ছেলের মধ্যেও, কে জানত! প্রথম গোলটা করার পর সেটাই করল এ দিনের নায়ক।

পরপর দু’ম্যাচে জোড়া হ্যাটট্রিক, সবাইকে টপকে সেরা গোলদাতা হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া ব্রিউস্টার সত্যিই যেন কাঁদিয়ে দিয়ে গেল যুবভারতীকে। কেড়ে নিল শহরের বিশ্বকাপ নিয়ে সব আবেগ, জৌলুস, উত্তেজনা। সেই ইংল্যান্ড স্ট্রাইকার বুকে চাপড় মেরে গ্যালারিকে মারোদোনার ঢঙে তো বলবেনই, ‘‘আমি আছি, আমাদের কে হারাবে? তা তোমরা যতই আমার বিপক্ষে থাক।’’ তার তো আজ বলার দিন।

ছোট ছোট কোঁকড়া চুল ব্রিউস্টারের। উচ্চতা কম। গতি-ই তাঁর সেরা সম্পদ। গোল করার পর শিশুর মতো আবেগে ভাসে। গোলের সামনে ছেলেটা ঘোরে ক্ষুধার্ত চিতাবাঘের মতো। স্টোক সিটির বিরুদ্ধে প্রিমিয়ার লিগের অনূর্ধ্ব ১৮ টিমের হয়ে নেমে অসাধারণ গোল করার পর ব্রিউস্টারকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন খোদ য়ুর্গেন ক্লপও। হিরে চিনতে ভুল করেননি লিভারপুল কোচ। আজ এ দিনের কোচ স্টিভ কুপার তাকে জড়িয়ে মাঠ ছাড়লেন।

এ বারের বিশ্বকাপে যাদের তারকা হিসাবে ধরা হচ্ছিল সেই পাওলিনহো, লিঙ্কন, জেডন স্যাঞ্চো, ইয়ান ফিটো আর্প, দিয়েগো লাইনেজ, টিম উইয়া সবাই তো বিদায় নিল একে একে। সেই অর্থে রিয়ান ব্রিউস্টার সত্যিই ‘সারপ্রাইজ প্যাকেজ’। ইংল্যান্ডের তো বটেই, টুনার্মেন্টেরও। গ্রুপ স্টেজের গোল মিসের ‘খলনায়ক’, শেষ দুটো ম্যাচে নায়ক— কবে যে কে সিংহাসনে বসে যায়! তার পায়েই যে পেলে-রোনাল্ডোর দেশে অন্ধকার নামল। ঠিক যেন, তিন বছর আগের বিশ্বকাপের মতো।

ব্রাজিল সেই অর্থে খেলতেই পারেনি এ দিন। ইংল্যান্ডের প্রেসিং ফুটবলের সামনে উড়ে গেল সাম্বা। ঝড়ের মতো। খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো গোল করে ওয়েসলি ১-১ করে কোমর দোলালেও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ-ঝড়ে ভেসে গেল সাম্বার দেশ। এবং তার নেতৃত্ব দিলেন চার পজিসনের চার জন। সামনে ব্রিউস্টার, উইংয়ে ক্যালাম হাডসন, মাঝমাঠে ফিলিপ ফডেন এবং রক্ষণে জোয়েল লাটিবিউডিয়েরা। এর মধ্যে ফডেনকে বেশি নম্বর দিতে হবে পাওলিনহো নামক ব্রাজিলের ‘পাওয়ার হাউস’-কে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ব্রাজিলের পাসের ফুলঝুরিতে জল ঢালার জন্য। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির ফডেন শুধু টিমের চালিকা শক্তিই নয়, ব্রিউস্টারের দু’টো গোলের পাসও তার।

ইংল্যান্ড এ বার অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, অনূর্ধ্ব-১৭ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স, তারপর এই টুনার্মেন্টে প্রথমবার ফাইনালে ওঠা— বিশ্ব বয়সভিত্তিক ফুটবলে যেন সোনার সময় চলছে ব্রিটিশদের। টুনার্মেন্টে ছয় ম্যাচে ১৮ গোল যাঁদের হয়ে গেল, তাদের ব্রাজিল রুখবে কী করে? কিংবদন্তি চুনী গোস্বামীর মতো ব্রাজিলের পাসিং ফুটবলের ভক্তও বলছিলেন, ‘‘এই ব্রাজিলকে তো আমরা দেখতে চাই না। ব্রাজিল মানেই সুন্দর ফুটবল। মাঝমাঠে খেলেই দেখলাম এরা সন্তষ্ট। গোল করার ইচ্ছেই নেই।’’

ব্রাজিলের পতনের পিছনে থাকছে গোলকিপার গ্যাব্রিয়েল ব্রাজাওয়ের হাতও। তার বল গ্রিপ না করে ঘুষি মেরে বের করার প্রবণতার ফল পেয়েছে দল। ব্রিউস্টারের দু’টি গোলই গোলকিপারের হাত থেকে বেরিয়ে আসা ফিরতি বলে করা। টিম হোটেলে ফিরে সে সব নিয়ে কাটাছেঁড়া করুন কার্লোস আমেদেউ। আপাতত বাংলার ক্যাচলাইন— ব্রাজিল নেই, বিশ্বকাপের আর থাকলটা কী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE