নবান্নে নেপালের কনসাল জেনারেল চন্দ্রকুমার ঘিমিরে।—নিজস্ব চিত্র।
আরও চব্বিশ ঘণ্টা পার। ছন্দা গায়েন ও তাঁর দুই সঙ্গী শেরপার এখনও কোনও খবর নেই।
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, শুক্রবার বিকেলে উদ্ধারকারী দল নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছেন দুই পর্বতারোহী উজ্জ্বল রায় ও দেবদাস নন্দী। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় দুর্ঘটনাস্থলের উদ্দেশে উড়তে পারেনি হেলিকপ্টার। আজ, শনিবার সকালে ফের তল্লাশি শুরু করার চেষ্টা হবে। উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে থাকবেন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাশি শেরপা।
সরকারি সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একটা সময়ে ছন্দার মা ও ভাইকে নিয়ে নেপালে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কোনও মুখ্যমন্ত্রীর বিদেশে যাওয়া বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতিসাপেক্ষ। এ দিন মন্ত্রকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়।
তবে নেপাল সরকার যথাসাধ্য করছে বলে জানান সে দেশের কনসাল জেনারেল চন্দ্রকুমার ঘিমিরে। তিনি বলেছেন, ছন্দাদের পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তল্লাশি চলবে। বেশি উচ্চতায় ওড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন হেলিকপ্টার ধসের এলাকায় নজরদারি চালাবে। কিছু দেখা গেলে দড়ি বেয়ে নামবেন (স্লিদারিং অপারেশন) কম্যান্ডো এবং দক্ষ শেরপারা। কিন্তু শুধু ঘটনাস্থলে পৌঁছলেই তো হল না, হেলিকপ্টারকে দীর্ঘ সময় স্থির হয়ে ভেসেও থাকতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই আবহাওয়া।
কাজেই দীর্ঘতর হচ্ছে অপেক্ষা। পর্বতারোহী মহলের একাংশ অবশ্য গোড়া থেকেই বলে আসছেন যে, তোড়জোড়ে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। চটজলদি উদ্ধারকাজ শুরু করা গেলে হয়তো ছন্দাদের নিয়ে আরও বেশি আশা থাকত।
কেন এত দেরিতে শুরু হচ্ছে উদ্ধারকাজ? শুধুই কি প্রতিকূল আবহাওয়া? গত বছর ধবলগিরি শৃঙ্গের পথে তুষারঝড়ের মুখে পড়েছিলেন বসন্ত সিংহরায়। সেই সময়ে নীচের ক্যাম্প থেকে উদ্ধারকাজ তদারক করেছিলেন অভিযানের অন্য দুই সদস্য দেবাশিস বিশ্বাস ও মলয় মুখোপাধ্যায়। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে মলয় জানালেন, নেপালের কোনও পর্বতারোহণ সংস্থা অভিযানের ব্যবস্থা করলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে উদ্ধারের দায়িত্বও তারা নেয়। তবে সরাসরি নয়। আলাদা ‘রেসকিউ এজেন্সি’র সঙ্গে তাদের বন্দোবস্ত থাকে। ওই উদ্ধারকারী সংস্থাই স্ট্রেচার, অক্সিজেন সিলিন্ডার ইত্যাদি-সহ হেলিকপ্টার পাঠায় দুর্ঘটনাস্থলে। তাতে খরচ হয় মোটা টাকা। যেমন, কাঠমাণ্ডু থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেস ক্যাম্পে হেলিকপ্টার পাঠাতে খরচ পড়বে মোটামুটি তিন লক্ষ টাকা। অভিযাত্রী দল অথবা সরকার সেই খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দিলেই তৎক্ষণাৎ সক্রিয় হতে বলা হয় উদ্ধারকারী সংস্থাকে। মলয় জানালেন, বসন্তকে উদ্ধার করার সময়ে মূলত দেবাশিসের প্রতিশ্রুতিতেই দ্রুত হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছিল তাঁদের ব্যবস্থাপক সংস্থা। তাঁর ক্ষোভ, “কলকাতা থেকে নেপালে যাওয়ার বদলে যদি ছন্দার অভিযানের ব্যবস্থাপক মিংমা শেরপার অ্যাকাউন্টে প্রয়োজনীয় টাকা পাঠিয়ে দেওয়া যেত, তবে হয়তো আর একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছত হেলিকপ্টার।”
তবে টাকাপয়সার জটিলতা এড়ানোর অন্য উপায় রয়েছে বলে জানালেন আর এক অভিজ্ঞ পর্বতারোহী দেবরাজ দত্ত। ‘রেসকিউ ইনসিওরেন্স’ বা উদ্ধার-বিমা। কিছু বিদেশি সংস্থা আছে, যারা অভিযানের আগে আরোহীদের দিয়ে বিমা করিয়ে রাখে। চুক্তি অনুযায়ী, নিজের দেশের বাইরে কোনও অভিযানে দুর্ঘটনায় পড়লে ওই সংস্থাই তৎক্ষণাৎ হেলিকপ্টার পাঠিয়ে উদ্ধার করে আনবে তাঁকে। দেবরাজ জানালেন, এই বছরেই এভারেস্টে যাওয়ার আগে ‘গ্লোবাল রেসকিউ’ নামে একটি মার্কিন সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন তিনি। লেগেছিল মাত্র ২০ হাজার টাকা। মেয়াদ এক বছর। প্রিয় ছাত্রী ছন্দাকে এই বিমার কথা জানিয়েওছিলেন বসন্ত সিংহরায়। কিন্তু তা আর করিয়ে উঠতে পারেননি ছন্দা।
পাঁচ বার এভারেস্টজয়ী পূর্বা শেরপা বলছিলেন গত মাসে এভারেস্টের খুম্বু আইসফলে দুর্ঘটনার কথা। বললেন, “কাছাকাছি বেস ক্যাম্পে অনেক জন শেরপা ছিলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে বরফ খুঁড়ে দেহ বার করতে শুরু করি।” জানালেন, কী ভাবে আইস এক্স (তুষার গাঁইতি) দিয়ে বরফ পিটিয়ে হেলিপ্যাড বানিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এসেও গিয়েছিল হেলিকপ্টার। তিন জনকে জীবিত উদ্ধার করা গিয়েছিল। সকলেরই নেপাল সরকারের উদ্ধার-বিমা করানো ছিল বলেই সময় নষ্ট হয়নি।
আপাতত চিন্তা একটাই। কখন হেলিকপ্টার পৌঁছয় কাঞ্চনজঙ্ঘার সেই কালান্তক খাঁজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy