সকাল থেকে গোটা গ্রামে আলোচনা একটাই, কী হবে কামদুনি মামলার রায়।
রান্নাবান্না তাড়াতাড়ি সেরে টিভির সামনে বসে পড়েছিলেন দুই নিযার্তিতাও। কী হয়? কেননা তাঁরাও যে অত্যাচারের শিকার। দুপুর সওয়া ২টো নাগাদ যখন টেলিভিশনে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার চ্যানেলে ভেসে উঠল কামদুনি মামলার রায়, অস্ফুট ভাবে দুই নির্যাতিতার মুখ থেকেই বেরিয়ে এল, ‘যাক, বিচার রয়েছে। মেয়েটা বিচার পেল’। তাঁদের সঙ্গেই গোটা গ্রামের মানুষও মামলার রায়ে উল্লসিত। সেই সঙ্গে আশা দেখছেন, তাঁদের দুই প্রতিবেশীও সুবিচার পাবেন।
২০১৩ সালের ৭ জুন ঘটেছিল কামদুনি। তার ঠিক মাস সাতেক পরে হাওড়ার আমতার মুক্তিরচক গ্রামে ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘটেছিল এক গৃহবধূ এবং তাঁর জেঠশাশুড়িকে গণধর্ষণের ঘটনা। কামদুনির ঘটনার সঙ্গে অনেকাংশেই নিজেদের মিল দেখতে পাচ্ছেন মুক্তিরচকের দুই নির্যাতিতা। গৃহবধূর জেঠশাশুড়ি বলেন, ‘‘কামদুনির ওই কলেজ ছাত্রীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ৯ জন। আমাদের উপরেও তো অত্যাচার করেছিল ১০ জন। শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল আমাদের। ওই মেয়েটাকে খুন করেছিল ওরা। আমরা বেঁচে হয়তো আছি, কিন্তু মানসিকভাবে খুন হয়ে গিয়েছি। সেই রাতের যন্ত্রণার কথা ভুলতে পারি না।’’ মুক্তিরচকের ওই ঘটনায় মোট ১০ জন অভিযুক্তের সকলেই ধরা পড়েছে। মামলার বিচার চলছে আমতার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে।
কী হয়েছিল ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে?
ওইদিন ছিল সরস্বতী পুজো। রাতে খাওয়াদাওয়া করে পাশাপাশি ঘরে শুয়েছিলেন ওই গৃহবধূ এবং তাঁর জেঠশাশুড়ি। রাত ১১ টা নাগাদ বরুণ মাখাল এবং রঞ্জিত মণ্ডলের নেতৃত্বে জনাদশেক যুবক পাঁচিলের দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢোকে। ওই গৃহবধূ এবং তাঁর জেঠশাশুড়ির ঘরের দরজা ভেঙে তাঁদের উঠানে ফেলে গণধর্ষণ করে। তাঁদের প্রথমে আমতা গ্রামীণ হাসপাতাল, পরে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই গ্রামে হানা দিয়ে সাতজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কয়েকদিন পরে ধরা পড়ে প্রধান অভিযুক্ত বরুণ মাখাল এবং রঞ্জিত মণ্ডল। আরও এক অভিযুক্ত ঘটনার প্রায় এক বছর পরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ঘটনার ৮৭ দিনের মাথায় পুলিশ ধৃতদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। চার্জশিটে বরুণকে মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত করে পুলিশ। উল্লেখ্য, ধৃতেরা সকলে তৃণমূল কর্মী-সমর্থক হিসাবে পরিচিত। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বরুণ এবং রঞ্জিত মুক্তিরচক গ্রাম থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিল। যদিও তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হয়, অভিযুক্তরা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের বিচারে আইন তার নিজের পথে চলবে।
তবে মামলার বিচার প্রক্রিয়া সহজে শুরু করা যায়নি। সরকারি আইনজীবী ঠিক না হওয়ায় বিচার শুরু হতেই দেরি হয়ে য়ায়। পরে সরকারি আইনজীবী ঠিক করা হলেও শুনানি শুরুর আগে হঠাৎই তিনি পদত্যাগ করেন। ব্যাহত হয় বিচার প্রক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত সরকার আইনজীবী নিয়োগ করায় ২০১৪ সালের শেষ দিকে বিচার শুরু হয়। এখনও পর্যন্ত চিকিৎসক, নার্স এবং পুলিশের সাক্ষ্যগ্রহণ বাকি।
তবে এ দিন কামদুনির রায় তাঁদের মনে সুবিচার পাওয়ার আশা জাগালেও, বিচারপতি দুই অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেওয়ায় কিছুটা আশ্চর্য দুই নির্যাতিতার একজন বলে ওঠেন, ‘‘দু’জন কী করে বেকসুর খালাস হল বুঝতে পারছি না। পুলিশের তদন্তে নিশ্চয় গাফিলতি ছিল। তবে দোষীদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।’’ একই কথা গ্রামবাসীদেরও। গত দু’বছর ধরে দুই নির্যাতিতার পরিবারের পাশে আছেন তাঁরা। বিবেক গায়েন, কাশীনাথ পাত্র বলেন, ‘‘দু’জন বেকসুর খালাস পেলেও ৬ জনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের মনে আশা জাগিয়েছে, সুবিচার আমরাও পাবো।’’
তবে মুক্তিরচকের মানুষের কাছে কামদুনি মামলার রায় সেমিফাইনালে জয়। তাঁদের অপেক্ষা এখন ফাইনাল (মুক্তিরচক মামলার রায় দানের দিন)-এর জন্য। যেখানে জয় ছাড়া আর কিছুই চায় না মুক্তিরচক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy