Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

চেনা মেয়েদের ভোলবদলে অবাক দুই গ্রাম

এক সময় সাত চড়ে রা না কাড়া মেয়ে নাকি অস্ত্র তাক করেছিল পুলিশের দিকে আগের রাজিয়া বিবির সঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্ত মহিলাকে এখনও মেলাতে পারছে না নদিয়ার বারবাকপুর। একই দশা মুর্শিদাবাদের তালগড়িয়া গ্রামেরও। রাজিয়ার মতো একই ধরনের অভিযোগে ধরা হয়েছে সে গ্রামের মেয়ে আলিমা বিবিকে। কিন্তু শান্ত, সাধারণ বলেই আলিমাকে মনে রেখেছেন তার বাপের বাড়ির এলাকার লোকজন।

পুলিশের চিঠি পড়ছেন আলিমার মা-বাবা-ভাই। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

পুলিশের চিঠি পড়ছেন আলিমার মা-বাবা-ভাই। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

কল্লোল প্রামাণিক ও শুভাশিস সৈয়দ
করিমপুর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

এক সময় সাত চড়ে রা না কাড়া মেয়ে নাকি অস্ত্র তাক করেছিল পুলিশের দিকে আগের রাজিয়া বিবির সঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্ত মহিলাকে এখনও মেলাতে পারছে না নদিয়ার বারবাকপুর। একই দশা মুর্শিদাবাদের তালগড়িয়া গ্রামেরও। রাজিয়ার মতো একই ধরনের অভিযোগে ধরা হয়েছে সে গ্রামের মেয়ে আলিমা বিবিকে। কিন্তু শান্ত, সাধারণ বলেই আলিমাকে মনে রেখেছেন তার বাপের বাড়ির এলাকার লোকজন।

নদিয়ার করিমপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম বারবাকপুরে সোমবার রাজিয়ার বাবা আজিজুল গাজি বলেন, “ও তো কথা বলতেই লজ্জা পেত। সাতটা কথা বললে একটার জবাব দিত। বিশ্বাস না হলে গাঁয়ের লোককে জিজ্ঞাসা করুন।” পড়শিরাও বলছেন, “ছোট থেকেই রাজিয়া অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র স্বভাবের মেয়ে। কী করে ওর বিরুদ্ধে যে এমন অভিযোগ উঠল, বুঝতে পারছি না!”

২০০৭-এ রাজিয়ার বিয়ের কথা স্পষ্ট মনে আছে গ্রামের লোকজনের। বারবাকপুরের এক মাদ্রাসায় রাজিয়া তখন নবম শ্রেণির ছাত্রী। সাইকেলে চেপে মেয়েদের পোশাক বিক্রি করতে গ্রামে আসত শাকিল। ভদ্র ব্যবহারের জন্য গ্রামের লোকজন তাকে পছন্দও করতেন। আজিজুল জানান, সেই সময় ছোট মেয়ে রাজিয়ার জন্য হন্যে হয়ে পাত্র খুঁজছিলেন তিনি। শাকিল বিয়ের প্রস্তাব দিতে তা কার্যত লুফে নেন। তিনি বলেন, “পাড়ার অনেকে ভাল করে শাকিল সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলেছিল। তখন অত ভাবিনি। এখন বুঝতে পারছি, ভুল হয়ে গিয়েছে।”

প্রৌঢ়ের দাবি, বিয়ের পরে মাত্র তিন দিন শ্বশুরবাড়িতে ছিল শাকিল। তারপরে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায়। বছর চারেক আগে এক বার সস্ত্রীক গ্রামে এসেছিল সে। সেই সময় শ্বশুরকে বাবা বলে পরিচয় দিয়ে বারবাকপুরের ঠিকানায় একটি ভোটার কার্ড জোগাড় করে শাকিল। আজিজুলের আক্ষেপ, “জামাই বলল, ভোটের কার্ড হারিয়ে গিয়েছে। ও বারবাকপুরে থেকেই ব্যবসা করবে। রাজিয়াও সাহায্য চাইল। মেয়ে-জামাইয়ের কথা ভেবেই নতুন ভোটার কার্ডে নাম ব্যবহারে সম্মতি দিই। সেটা ভুল হয়ে গিয়েছে।”

পুলিশ মারফত খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে শাকিলের মৃত্যুসংবাদ এবং রাজিয়ার গ্রেফতার হওয়ার খবর এসে পৌঁছয় গত শুক্রবার। তার পরেই ভয়ে বাড়ি ছেড়েছিলেন আজিজুল। সোমবার ফিরেছেন। খোঁজ নিতে আসা পড়শিরা অনেকেই বলে যাচ্ছেন, “রাজিয়ার বিয়েটাই কাল হল!” মাথা নাড়তে নাড়তে মেনে নিচ্ছিলেন প্রৌঢ়।

বিয়ে নিয়ে পরিবারে অশান্তি হয়ে থাকলেও মেয়ে আলিমা এবং জামাই আবদুল হাকিমকে মেনেই নিয়েছিলেন সোলেমান শেখ। মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের তালগড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশ পেরনো সোলেমান পেশায় দিনমজুর। তবে তাঁর সাত ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনার জন্যই বছর চারেক আগে বর্ধমানের মঙ্গলকোটের একটি মাদ্রাসায় বড় মেয়ে আলিমাকে ভর্তি করেছিলেন সোলেমান। আলিমার সঙ্গে মাদ্রাসার রাঁধুনি আবদুল হাকিমের সেখানেই পরিচয়-পরিণয়।

বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে হওয়ায় আলিমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না বলে দাবি সোলেমানের। জানালেন, পরে অবশ্য দু’পক্ষের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। আলিমার সন্তান ফতেমার জন্মও তালগড়িয়ার বাড়িতেই। প্রৌঢ়ের কথায়, “গত ঈদ-উল-ফিতরের তিন দিন আগেও মেয়ে, জামাই ও নাতনি আমাদের এখানে এসেছিল। তখন আলিমা বলেছিল, বেলডাঙায় বোরখা তৈরির পাশাপাশি একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করবে। ফলে, আমরা জানতাম ওরা বেলডাঙায় আছে।”

সোলেমানের সে ভুল ভাঙে পুলিশের খবরে। শুক্রবার জানতে পারেন, বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে জখম হয়ে তাঁর জামাই চিকিৎসাধীন। মেয়ে পুলিশ-দমকলের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে গ্রেফতার হয়েছে।

এই খবরেই ধাক্কা লেগেছে সোলেমানের অনেক পড়শিরও। তাঁরা জানাচ্ছেন, ছোট থেকেই আলিমা শান্ত স্বভাবের, কম কথা বলে। তার স্বামী আবদুল হাকিম শ্বশুরবাড়িতে এলেও মেলামেশা করত না। তবে নিয়ম করে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্তের নমাজ পড়ত। আলিমার পড়শিদের বক্তব্য, “বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সোলেমানের পরিবারটা ভাল। আলিমা মেয়েটাও ভীষণ ভাল। পুলিশ যেন সে দিকটাও মাথায় রাখে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE