Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

জুজু বিজেপি, নারাজ নন বাম-নামে

ঠেলায় পড়লে বিড়াল নাকি গাছে ওঠে! বিজেপি-র জুজু দেখলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কি সিপিএম-কে বন্ধু ভাবেন? রাজ্য রাজনীতিতে এ যাবৎ অসম্ভব এক রাজনৈতিক সমীকরণের সম্ভাবনা হঠাৎই মাথাচাড়া দিল তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার একটি মন্তব্যে। রাজনীতিতে কেউই অচ্ছুত নয় বলে মন্তব্য করে মমতা জানালেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলায় এবং পরিস্থিতির প্রয়োজনে সিপিএমের তরফে কোনও প্রস্তাব এলে তিনি আলোচনায় রাজি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৪
Share: Save:

ঠেলায় পড়লে বিড়াল নাকি গাছে ওঠে! বিজেপি-র জুজু দেখলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কি সিপিএম-কে বন্ধু ভাবেন?

রাজ্য রাজনীতিতে এ যাবৎ অসম্ভব এক রাজনৈতিক সমীকরণের সম্ভাবনা হঠাৎই মাথাচাড়া দিল তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতার একটি মন্তব্যে। রাজনীতিতে কেউই অচ্ছুত নয় বলে মন্তব্য করে মমতা জানালেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলায় এবং পরিস্থিতির প্রয়োজনে সিপিএমের তরফে কোনও প্রস্তাব এলে তিনি আলোচনায় রাজি। এ কথা শোনামাত্র জল্পনা গতি পেয়েছে, তবে কি বিজেপি-র বিপদ সামলাতে তৃণমূল নেত্রী তাঁর এত দিনের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করে সিপিএমের হাত ধরতেও রাজি?

সিপিএমের তরফে অবশ্য পত্রপাঠ এমন সম্ভাবনা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। সিপিএম নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূলকে ধর্মনিরপেক্ষ বা গণতান্ত্রিক কোনও শংসাপত্রই দিতে তাঁরা নারাজ। কাজেই বন্ধুত্বের প্রস্তাব নিয়ে আলিমুদ্দিনের তরফে কালীঘাটের দ্বারস্থ হওয়ার প্রশ্ন আসছে না। তবে মমতার প্রস্তাবের শেষ পরিণতি যা-ই হোক, তাঁর কাছ থেকে সিপিএমের জন্য দরজা খোলা রাখার বার্তাই যথেষ্ট চমক তৈরি করেছে রাজ্য রাজনীতিতে! যে মমতা দিনের পর দিন সিপিএমের সঙ্গে সরকারি অনুষ্ঠানেও এক মঞ্চে থাকতে অস্বীকার করেছেন, কংগ্রেসকে ‘সিপিএমের বি টিম’ বলে কটাক্ষ করেছেন, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা সিপিএম-কে সামাজিক বয়কটের ডাক দিয়েছেন, কেউ সাপের মতো পিটিয়ে মারার নিদান দিয়েছেন, সেই দলের দিক থেকেই সিপিএমের জন্য ‘অচ্ছুত নয়’ বার্তা চমকপ্রদ বৈকি!

সদ্যই বিহারের ১০টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে দু’দশকেরও বেশি সময়ের বৈরিতা ভুলে একজোট হয়েছিলেন নীতীশ কুমার ও লালুপ্রসাদ যাদব। সেই মহাজোটে সামিল হয়েছিল কংগ্রেসও। শেষ পর্যন্ত ৬টি আসনে জিতে মহাজোট বিজেপি-র অগ্রগতি আপাতত রুখে দিতে পেরেছে। এই ‘বিহার মডেল’ নিয়েই শুক্রবার একটি ২৪ ঘণ্টার বৈদ্যুতিন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল মমতাকে। নীতীশজি-লালুজি এবং কংগ্রেসকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এখানেও তেমন পরিস্থিতি এলে ভাবব। আমরা তো আগে এসইউসি-র সঙ্গে চলেছি। আরও দু-একটা ছোট দলও ছিল আমাদের সঙ্গে।” তৃণমূল নেত্রীর আরও বক্তব্য, “কেউ এগিয়ে এলে কথা বলা যেতেই পারে। গণতন্ত্রে কথা বলা সব সময়ই ভাল। কথা বন্ধ করতে নেই। কেউ অচ্ছুত নয়। কোন অপশন ভাল, কোন অপশন শান্তির এবং উন্নয়নের, সেটা দেখতে হবে।”

তার মানে কি পরিস্থিতির প্রয়োজনে তিনি সিপিএমের সঙ্গেও যেতে পারেন? মমতার জবাব, “সে কথা তো বলিনি! তবে যদি কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসে, তা হলে আলোচনা হতেই পারে। আমাদের দলে আলোচনা করতে হবে। আমরা সব সময় আলোচনার পক্ষে।” একই সাক্ষাৎকারে সারদা-কাণ্ড এবং রাজ্যের উপরে ঋণের বোঝার প্রশ্নে সিপিএম-কে তুলোধোনাও করেছেন মমতা। কিন্তু তিনিই যে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সিপিএমের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা খারিজ করে দিচ্ছেন না, মোচড় এখানেই!

সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এত সহজে তৃণমূল নেত্রীকে বন্ধু ভাবতে যাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, “রাজ্যে বিজেপি-কে ডেকে এনেছিলেন উনিই। আর এখন রাজ্য জুড়ে যে সন্ত্রাস চলছে, বিরোধীদের উপরে যে ভাবে আক্রমণ হচ্ছে, এ ভাবে গণতন্ত্র বিপন্ন হলে কখনওই ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করা যায় না। উনি এবং ওঁর দল যা করছে, তাতে বিজেপিরই সুবিধা হচ্ছে।”

আর দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা সাংসদ মহম্মদ সেলিমের কথায়, “প্রথম বার এনডিএ-তে যোগ দিয়েও বলেছিলেন, কেউ অচ্ছুত নয়। এখন আবার সেই কথা বলার মানে তো উল্টো দিকে এটাও বোঝায়, নরেন্দ্র মোদীও অচ্ছুত নন!” তাঁদের দিক থেকে তৃণমূলের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে কি? সেলিমের বক্তব্য, “যাওয়ার আগে কার কাছে যাচ্ছি, ভাবতে হবে! ওঁকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চেয়ে কিষেণজির কী পরিণতি হয়েছে? ওঁর হাত ধরতে গিয়ে এসইউসি-র কী অবস্থা হয়েছে? এ সব মাথায় রাখতে হবে!”

বামেদের প্রতি মমতার তুলনামূলক নরম অবস্থান অবশ্য এই প্রথম নয়। বিরোধী থাকাকালীন তিনি বামেদের সঙ্গে কোনও আদানপ্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। সরকারে আসার পরেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত চেয়ে বামেদের নানা সংগঠনের আর্জি প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের পরে প্রথম বার বিমান বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদলকে সময় দিয়েছিলেন তিনি। লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপি-র উত্থানের ফলে রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে গিয়ে বামেরা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তাদের আর মূল শত্রু বলে বিবেচনা করছেন না মমতা এবং সেই জন্যই আলোচনায় রাজি হয়েছেন, এমনই মনে করা হয়েছিল সেই সময়।

নবান্নের সেই সাক্ষাতেও বিমানবাবুদের কফি-ফিশফ্রাই সহযোগে আপ্যায়ন করে বিজেপি-মোকাবিলায় ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী! জানতে চেয়েছিলেন, বাম দল ছেড়ে কর্মী-সমর্থকেরা কেন বিজেপি-তে যাচ্ছেন? নিজেদের সংগঠন সামলানোর জন্যও বিমানবাবুকে আর্জি জানিয়েছিলেন! সেই সাক্ষাৎকার নিয়ে বাম শিবিরে জলঘোলা কম হয়নি। বাম নেতৃত্বের একাংশ বলছেন, বিজেপি-কে রুখতে এখন অন্যদের পাশে পেতে চাইতে পারেন মমতা। কিন্তু বামেদের নিজস্ব বাধ্যবাধকতাই তাঁর দিকে হাত বাড়াতে দেবে না আলিমুদ্দিনকে।

বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অবশ্য বলছেন, “বাংলার মানুষ এক দিন সিপিএম-তৃণমূল সমঝোতা দেখবেন! তাঁরাই বিচার করবেন। সিপিএম-ও তাদের কিছু শর্ত মেনে নিলে তৃণমূলের সঙ্গে যেতে আপত্তি করবে না।” তবে তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতা দাবি করেছেন, “দলনেত্রী সিপিএমের সঙ্গে জোটের কথা বলেননি। বর্তমান পরিস্থিতির যে মূল্যায়ন তিনি করেছেন, তার ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।” রাতে তৃণমূলের ওয়েবসাইটে মমতার সাক্ষাৎকারের যে বয়ান দেওয়া হয়েছে, তাতে সিপিএমের সঙ্গে কথার প্রসঙ্গটি নেই।

সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর বন্ধুত্বের সম্ভাবনা শুনে কেমন লাগছে? কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার জবাব, “উনি কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার। তবে এটুকু বলতে পারি, বিজেপি-র সঙ্গে লড়াই করার জন্য উপযুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি কংগ্রেসই।” বস্তুত, তৃণমূলের একাংশের ধারণা, সিপিএমের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলে রাখার কথা আদতে একটি তাত্ত্বিক সম্ভাবনা মাত্র। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কাছাকাছি হওয়ার কথা বলে তৃণমূল নেত্রী আসলে বার্তা পাঠিয়ে রাখলেন কংগ্রেসের দুয়ারেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE