Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

তাপসের পথেই নির্মল, ‘জ্যান্ত পুতুল’ পোড়ানোর উস্কানি

তাপস পালের পর এ বার নির্মল মাজি। বঁটি দিয়ে গলার নলি কাটা, কুড়ুল দিয়ে দু’টুকরো করা, গুলি করে উড়িয়ে দেওয়া বিরোধীদের শায়েস্তা করতে নিজের প্রেসক্রিপশনে বিবিধ দাওয়াই বাতলেছিলেন সাংসদ তাপস পাল। এ বার তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন-এর সভায় সংগঠনের সভাপতি নির্মল মাজির প্রেসক্রিপশন ‘কুশপুতুলের বদলে জ্যান্ত পুতুল’ পোড়ানো।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

তাপস পালের পর এ বার নির্মল মাজি।

বঁটি দিয়ে গলার নলি কাটা, কুড়ুল দিয়ে দু’টুকরো করা, গুলি করে উড়িয়ে দেওয়া বিরোধীদের শায়েস্তা করতে নিজের প্রেসক্রিপশনে বিবিধ দাওয়াই বাতলেছিলেন সাংসদ তাপস পাল। এ বার তৃণমূল কংগ্রেসের চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন-এর সভায় সংগঠনের সভাপতি নির্মল মাজির প্রেসক্রিপশন ‘কুশপুতুলের বদলে জ্যান্ত পুতুল’ পোড়ানো। ‘জ্যাম্ত পুতুল’ বলতে তিনি কী বলতে চেয়েছেন তা জানতে চাওয়া হলে তৃণমূলের ওই ডাক্তার নেতার ব্যাখ্যা, “উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ অনুপ রায় এবং দার্জিলিং-এর মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর ভৌমিক সপ্তাহে দু’দিনের বেশি কাজ করতেন না। অথচ তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরে উত্তরবঙ্গে প্রশাসনের অনেকের কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে। এ বার সাধারণ মানুষ ওই ডাক্তারদের জ্যান্ত পুতুল পোড়ায় কি না দেখা যাক।”

তাঁর এই বক্তব্য কি নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার জন্য জনতাকে উস্কানি দেওয়া নয়? অনুষ্ঠান মঞ্চের বাইরে এ প্রশ্ন করা হলে নির্মলবাবুর জবাব, “পরিষেবা না পেলে মানুষ কী করবে? তাদের তো রুখে দাঁড়াতেই হবে। এ ভাবে চলতে থাকলে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে লোক জনের জামাপ্যান্ট খুলে নেবে জনতা।”

উত্তরবঙ্গের এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতিতে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ এনে উত্তরবঙ্গে চার আধিকারিককে সাসপেন্ড করার পরে রাজ্যের চিকিৎসক মহল প্রকাশ্যেই দু’ভাগ হয়ে যান। বেছে বেছে সিপিএম সমর্থিত ডাক্তার সংগঠনের সদস্যদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করে গত ১২ অগস্ট এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের জেনারেল লেকচার থিয়েটারে একটি সমাবেশের ডাক দিয়েছিল সিপিএম সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস (এএইচএসডি)। সেখানে ডাক্তাররা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করে অবিলম্বে চার জনের সাসপেনশন তুলে নেওয়ার দাবি জানান। সরকার দাবি না মানলে আন্দোলনের হুমকিও দেওয়া হয়।

জনা ৭০ চিকিৎসক হাজির ছিলেন ওই সমাবেশে। পরের দিনই হাজিরার ওই সংখ্যাকে কটাক্ষ করে স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছিলেন, রাজ্যে ১০ হাজারের বেশি সরকারি চিকিৎসকের মধ্যে ৬০-৭০ জন কী বললেন, তাতে তাঁরা বিচলিত নন। এক সপ্তাহের মধ্যেই পাল্টা সমাবেশ ডেকে তৃণমূলের ডাক্তার সংগঠন এ দিন জানান দিতে চাইল, পাল্লা ভারী তাদের দিকেই।

এএইচএসডি-র সভায় কী ভাবে চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতি করা যায়, সে ব্যাপারে কিছু গঠনমূলক কথাও ছিল। এ দিন অবশ্য গুরুত্ব পেয়েছে শুধুই ব্যক্তিগত আক্রমণ। নির্মল মাজির এ দিনের মন্তব্যকে ‘গুন্ডামি’ বলে অভিহিত করেছেন এএইচএসডির সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ চক্রবর্তী। তাঁর বক্তব্য, “ডাক্তারা আগে কখনও প্রকাশ্যে এই ভাষায় কথা বলেননি। এ বার সেই সংস্কৃতিও আমদানি হল!” এএইচএসডি-র সভাপতি গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা স্তম্ভিত। ডাক্তার সংগঠনের সভাপতির মুখে এমন কথাই মানায় বটে!”

উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ অনুপ রায় নির্মলবাবুর অভিযোগ মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “সাসপেনশনে আছি, তাই কিছু বলব না। হাজিরা খাতাই যা বলার বলবে।” অনুপবাবুর বিরুদ্ধে সপ্তাহে দু’দিন কাজ করার অভিযোগ নস্যাৎ করে সত্যজিৎবাবু বলেন, “সরকারি কাজ না থাকলে উনি কখনও কলকাতায় আসতেন না। তা ছাড়া সাসপেন্ড করার সময় এ সব কথা বলা হয়নি। এখন ইচ্ছা করে নানা নতুন অভিযোগ আনা হচ্ছে।” সাসপেন্ড মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর ভৌমিকও নির্মলবাবুর অভিযোগের জবাব দিতে অস্বীকার করেছেন।

এ দিন বিকেল চারটেয় সভা শুরুর কথা থাকলেও দুপুর তিনটে থেকেই ডাক্তারদের ভিড় জমতে শুরু করে জিএলটি-র সামনে। ঘর উপচে এমন ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় যে অনেকে পড়ে গিয়ে চোটও পান। বিভিন্ন হাসপাতালের সুপার, অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বিভাগীয় প্রধান, এমনকী জুনিয়র ডাক্তাররাও ভিড় করেন সভায়। এনআরএসে পৌঁছেই এই দৃশ্য দেখে নির্মল মাজি এক চিকিৎসককে হুকুম করেন, “অডিটোরিয়ামটা খুলে দিতে বলো। যা ভাড়া লাগবে, দেব।” দু’মিনিটের মধ্যে খুলে যায় অডিটোরিয়ামের দরজা। আগাম বুকিং না করে এ ভাবে কি আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? এনআরএস কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। তবে হাসপাতালের এক কর্তার কথায়, “কার সাহস আছে, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার?”

বক্তৃতা দিতে গিয়ে নির্মল মাজি প্রথম ১৫ মিনিট মমতা বন্দ্যোপাধায়ের নানবিধ গুণের বর্ণনা করেছেন। তার পরে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তৃণমূলের অবদান বুঝিয়েছেন। বক্তৃতার তৃতীয় পর্বে এসেছে, এনসেফ্যালাইটিস। তাঁর অভিযোগ, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ অনুপ রায় এবং দার্জিলিংয়ের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কেউই কাজের জায়গায় সপ্তাহে দু’দিনের বেশি থাকতেন না। প্রথম জন কলকাতায় এবং দ্বিতীয় জন শিলিগুড়িতে সপ্তাহের পাঁচ দিন কাটাতেন। এঁদের জন্যই এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতি গুরুতর আকার নিয়েছিল। চক্রান্ত করে এঁরা মৃত্যুর খবর গোপন রেখেছিলেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তার পরেই বলেন, “যারা কাজ করে না, তাদের কুশপুতুল পুড়বে নাকি জ্যান্ত পুতুল পুড়বে, তা জানা নেই।”

নির্মলবাবু এ কথা বলার সময়ে তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়ও মঞ্চে ছিলেন। ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক শিউলি সাহাও। নির্মল মাজির বক্তৃতা উস্কানিমূলক কি না, পরে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মুকুলবাবু বলেন, “ও রকম কোনও কথা আমার কানে আসেনি।” বক্তৃতায় মুকুল রায় বলেন, “প্রশাসন চালাতে গেলে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে গুলো সকলের মনের মতো না-ও হতে পারে!”

প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সর্কান্ত মিশ্রের বিরুদ্ধে নির্মলবাবুর অভিযোগ, “২০০৯ সালে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মশার লার্ভার মারার জন্য ১৬ লক্ষ টাকার গাপ্পি মাছ ছাড়ার বরাত পেয়েছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্রের এক ঘনিষ্ট আত্মীয়। কিন্তু সেই টাকায় ছাড়া গাপ্পি মাছ কোথায় গেছে কেউ জানে না।” এ ব্যাপারে সূর্যকান্তবাবু বলেন, “নির্মল মাজির বক্তব্য নিয়ে কিছু বলতে চাই না। গাপ্পি মাছের কিছু উপযোগিতা আছে। কিন্তু সেই কারবারে আমার কোনও আত্মীয় জড়িত নন।”

নাম না-করে সিপিএম নেতা গৌতম দেবের কথাও বলেন তৃণমূলের ডাক্তার নেতা। নির্মলবাবু বলেন, “সিপিএমের এক প্রাক্তন মন্ত্রী, যিনি মুখ বিকৃত করে হাত কাঁপিয়ে কথা বলতেন, দার্জিলিংয়ের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাঁর আত্মীয় হওয়ার সুবাদে টানা আট বছর সেখানে থেকে যেতে পেরেছেন।” গৌতম দেব স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছেন। এক জন চিকিৎসক হয়ে তিনি কী ভাবে এক জনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে এমন বিদ্রুপ করতে পারেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নির্মলবাবু অবশ্য জবাব দেননি।

ভাল আছেন তাপস পাল

অভিনেতা-সাংসদ তাপস পাল ভাল আছেন। তাঁর রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার পরিমাণও নিয়ন্ত্রণে আছে বলে বুধবার জানালেন চিকিৎসকেরা। মস্তিষ্কে ‘ইসকিমিক স্ট্রোক’-এর জন্য মঙ্গলবার সকালে তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাপস পালকে। তাঁর চোখেও কিছু সমস্যা হচ্ছিল। তৃণমূল সাংসদ তাপসবাবুর চিকিৎসক শুদ্ধকল্যাণ পাল এ দিন বলেন, “আস্তে আস্তে ওঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। কথাবার্তাও বলছেন, সম্পূর্ণ সজাগ আছেন। তাঁর মস্তিষ্কে একটি ধমনিতে ভাল ভাবে রক্ত চলাচল হচ্ছে না। তবে তাতে খুব ভয়ের কিছু নেই।” আপাতত আরও দু’দিন তাপসবাবুকে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটেই রাখা হচ্ছে বলে জানালেন শুদ্ধকল্যাণবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tapas pal nirmal majhi tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE