Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দিদি ডাকেই সভা মাতালেন মোদী

দিদি-ই-ই-ই...গুজরাতি প্রবীণের গলায় বাঁকা টান। আর জনতা পাগলপারা। দিদি, আপ বলিয়ে...সুরটা কখনও চড়ছে, নামছে খাদে, বাঁকছে-চুরছে, মোচড় খাচ্ছে। বাঁকা হাসছে। আর সামনে, পাশে, বাড়ির ছাদে, উপরে-নীচে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে জনতা। মুহূর্মুহূ চিৎকারে ডুবে যাচ্ছে বক্তার গলা মোদী, মোদী, মোদী...যেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোনও পপস্টার। বা এই মাত্র হাইকোর্ট এন্ড দিয়ে বলটা চুন্নি করে দিলেন সচিন।

কাঁকুড়গাছির নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদী ও রাহুল সিংহ। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

কাঁকুড়গাছির নির্বাচনী জনসভায় নরেন্দ্র মোদী ও রাহুল সিংহ। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও সুস্মিত হালদার
বারাসত ও কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৪ ০৩:২৬
Share: Save:

দিদি-ই-ই-ই...

গুজরাতি প্রবীণের গলায় বাঁকা টান। আর জনতা পাগলপারা।

দিদি, আপ বলিয়ে...

সুরটা কখনও চড়ছে, নামছে খাদে, বাঁকছে-চুরছে, মোচড় খাচ্ছে। বাঁকা হাসছে।

আর সামনে, পাশে, বাড়ির ছাদে, উপরে-নীচে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে জনতা। মুহূর্মুহূ চিৎকারে ডুবে যাচ্ছে বক্তার গলা মোদী, মোদী, মোদী...

যেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোনও পপস্টার। বা এই মাত্র হাইকোর্ট এন্ড দিয়ে বলটা চুন্নি করে দিলেন সচিন।

বাংলার মাটিতে পদ্ম-ফোটানো শারদ-বাতাস তিনি পেতে শুরু করেছিলেন শ্রীরামপুর থেকেই। গত সপ্তাহে বাঁকুড়া-আসানসোল ছুঁয়ে এখন তা প্রায় ঝড়। আর হাওয়ার সেই বদলটাই এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী।

বুধবার কৃষ্ণনগরে প্রথম সভা সেরে মোদী যখন বারাসতে পৌঁছলেন, মধুমূরলী মাঠে অস্থায়ী হেলিপ্যাড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাটআউট, পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুনে প্রায় ঘেরা। চপার থেকে নেমে যখন ইতি-উতি দেখছেন, পাশ থেকে এক বিজেপি নেতা ফিসফিস করে জানান, ‘আগের রাতেও এ সব ছিল না, জানেন! রাতারাতিই...।’ মুচকি হেসে মোদী বললেন, “এ ভাবে ভাবছেন কেন? উনি নিজে আসতে পারেননি, তাই এ ভাবেই করজোড়ে আমায় স্বাগত জানাতে হেলিপ্যাডে হাজির হয়েছেন। ভালই তো!”

জনজোয়ার কৃষ্ণনগরে মোদীর জনসভায় ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

হেলিপ্যাড থেকে কাছারি ময়দানের সভাস্থল মিনিট পাঁচেকের পথ। গাড়ি এগোচ্ছে, রাস্তার দু’ধারে তখন কাতারে কাতারে লোক। মোদী সমানে হাত নাড়ছেন আর ব্যাকসিটে বসা বিজেপি নেতাকে বলছেন “এটা তো বডোদরা বা বারাণসী নয়। বাংলার মাটিতে এত ভালবাসা পাব, এ আমার কল্পনারও অতীত। এর মধ্যে আমি ভবিষ্যৎ দেখছি।”

ভবিষ্যৎটা অবশ্য তিনি আসমান থেকেই দেখতে পাচ্ছিলেন। বারাসতের আকাশে সাদা হেলিকপ্টার দেখা দিতেই গোটা কাছারি ময়দানের হাজার হাজার হাত উপরে। সম্মিলিত ‘মোদী মোদী’ ধ্বনি চপারে বসেও শুনতে পাওয়া যায়। সেই ধ্বনি সারা পথ গড়াতে-গড়াতে যখন থামল, কথা বলার সুযোগ না পেয়ে মোদী কয়েক মিনিট মঞ্চে চুপ করে দাঁড়িয়ে।

মোদীর আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু তিনি যে এসেছেন, তাতেই সকলের দিল খুশ। সকাল থেকেই আসলে মেলা বসে গিয়েছিল কাছারি ময়দানে। ট্রেনে-বাসে বোঝাই হয়ে আসতে শুরু করেছিল ব্যারাকপুর-বনগাঁ-বসিরহাট। সারা মাঠ জুড়ে পোস্টার, ফেস্টুন, পদ্মফুলের কাট আউট, মোদীর ছবি। পোস্টারে লেখা, “আই অ্যাম মোদীফায়েড।” কারও মুখে মোদী-মুখোশ, কেউ বা আপাদমস্তক রং মেখে দাঁড়িয়ে। কেউ নিজের চেয়েও লম্বা পতাকা টানা নাড়িয়ে গিয়েছেন কেউ।

ইতিমধ্যে এক দল মতুয়া চলে এসেছেন কাঁসর-ডঙ্কা বাজিয়ে। দশ টাকায় মোদী, দশ টাকায় মোদী হইহই করে চটি বই ‘জিতবে ভারত’ বিক্রি করছেন ব্যারাকপুরের চন্দনপুকুর থেকে আসা ইংরেজি এমএ-র ছাত্র লব ঘোষ। ছাত্র পড়িয়ে তিনি নিজের পড়ার খরচ চালান। বললেন, “ঘুষ দিতে পারিনি। তাই টেট পরীক্ষায় পাশ করিনি। জানি না, পরিবর্তনের পরিবর্তন হবে কি না।”

কৃষ্ণনগরে শক্তিমন্দির মাঠে মোদীর আসার কথা ছিল ২টো নাগাদ। বিজেপি দেড়শো বাসের ব্যবস্থা করেছিল। ছোট-ছোট ট্রাকে-ম্যাটাডরেও সকাল থেকেই লোকে আসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। মোদী আসেন প্রায় দু’ঘণ্টা দেরিতে। তাতে টুকটুক করে বাড়ির পথ ধরার বদলে চড়া রোদ মাথায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন আবালবৃদ্ধবণিতা। কলেজ পড়ুয়াদের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি তুলনায় ছোট কারবালার মাঠে সভা করে গিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিনের ভিড় সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে।

প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের দিঘলকান্দি থেকে এসেছিলেন লক্ষ্মণ ঘোষ, গোপাল ঘোষেরা। ঘাম মুছতে মুছতে গোপালবাবু বলেন, “আমাদের প্রচুর আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশে থেকে এসেছে পরে। আমাদের নেতা বাংলাদেশিদের নিয়ে কী বলছেন, সেটা নিজের কানে শুনব বলে এসেছি।” শ্যামপুর থেকে নাতনির সঙ্গে আসা কমলা বিশ্বাসের সোজা কথা, “শুনছি, মোদী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। তাই আগেই দেখতে এলাম।”

দুই জায়গা ঘুরে সন্ধ্যায় মোদী যখন কলকাতার কাঁকুড়গাছিতে এসেছেন, ছবিটা এতটুকু পাল্টায়নি। লক্ষণীয় ভাবে চোখে পড়েছে জিনস-টি শার্টে ঝলমলে জেন ওয়াইয়ের উপস্থিতি, যার আবার একটা বড় অংশ তরুণীরা। মঞ্চের দিকে পিছন ফিরে মোদীর সঙ্গে এক ফ্রেমে সেলফি তুলতেও দেখা গিয়েছে অনেককে। শুরু থেকেই ছোট-ছোট তির্যক কথায় আক্রমণে গিয়েছেন পোড় খাওয়া নেতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে যত বার ‘দিদি-ই-ই-ই’ বলে টান দিয়েছেন, হাসির হররা তুলে দুলে উঠেছে মাঠ। বিরোধীদের লক্ষ করে মোদী মিছরির ছুরি শানিয়েছেন। জনতা কখনও দু’হাত তুলে জয়ধ্বনি দিয়েছে, কখনও সুরে সুর মিলিয়েছে।

একেবারে শেষের দিকে প্রায় মন্ত্র জপ করানোর মতো প্রশ্নোত্তরে চলে গিয়েছেন প্রবীণ গুজরাতি:

এখন কী কাল?

জনতা: গরম কাল।

গরম কখন বেশি, দুপুরে না সকালে?

সমস্বরে: সকালে।

তবে ভোট কখন দিতে হবে?

ময়দান: সকালে।

তা হলে আমার সঙ্গে বলুন ‘পহলে মতদান, ফির জলপান!’

সম্মোহিত হাজার কণ্ঠে প্রতিধ্বনি মতদান, মতদান!

বারাসতের মাঠে ছোট-ছোট পাউচে রঙিন শরবত বিক্রি করছিলেন বিড়ার শ্রীবাস বিশ্বাস। কিন্তু লাল, সাদা, সবুজ নেই, শুধু কমলা। বাকি রং গেল কোথায়? শ্রীবাস হাসেন, “সব গেরুয়া। অন্য রঙের বিক্রি নেই দাদা!” বেড়াচাঁপা থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছিল কেজি ওয়ানের দেবার্ঘ্য দাস। কেন এসেছো? কচি গলায় চটপট জবাব, “মোদী আঙ্কেলকে দেখব।” বলতেই পাশ থেকে পিঠে মায়ের হাতের আলতো চাপড়, “আঙ্কেল আবার কী? বলো, মোদীজিকে দেখতেই এখানে এসেছি।”

আর মোদী বলে গেলেন, “ভালবাসা দিয়ে বাংলা আমায় জিতে নিয়েছে। ছেলের প্রতি মায়ের যে অধিকার, ভাইয়ের প্রতি বোনের যে অধিকার, আমার প্রতিও তা-ই। আমি বাংলারই হয়ে গেলাম।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

arunakkha susmit modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE