Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ধৃতরা জামাতের লোক, বলল এনআইএ

বোমা বানাতে গিয়ে একটি বিস্ফোরণে দু’জন নিহত এবং এক জন আহত— এক কথায় বলতে গেলে খাগড়াগড়ের ঘটনার নির্যাস এটুকুই। কিন্তু শুক্রবার সেই খাগড়াগড়েই সটান চলে এলেন খাস এনআইএ-র ডিজি শরদ কুমার। কারণ আর কিছুই নয়, এনআইএ সূত্রেই বলা হচ্ছে, ডিজি নেহাত একটি বিস্ফোরণস্থল দেখতে আসেননি। এসেছেন এমন জায়গায়, যেখান থেকে ভিন দেশেও নাশকতা ঘটানোর প্রস্তুতি চলছিল।

শাকিলের বোরখা কারখানায় তদন্তে এনআইএ-র ডিজি শরদ কুমার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

শাকিলের বোরখা কারখানায় তদন্তে এনআইএ-র ডিজি শরদ কুমার। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১০
Share: Save:

বোমা বানাতে গিয়ে একটি বিস্ফোরণে দু’জন নিহত এবং এক জন আহত— এক কথায় বলতে গেলে খাগড়াগড়ের ঘটনার নির্যাস এটুকুই। কিন্তু শুক্রবার সেই খাগড়াগড়েই সটান চলে এলেন খাস এনআইএ-র ডিজি শরদ কুমার। কারণ আর কিছুই নয়, এনআইএ সূত্রেই বলা হচ্ছে, ডিজি নেহাত একটি বিস্ফোরণস্থল দেখতে আসেননি। এসেছেন এমন জায়গায়, যেখান থেকে ভিন দেশেও নাশকতা ঘটানোর প্রস্তুতি চলছিল।

শুক্রবার, ডিজি-র সফরের দিনই সন্ধেবেলা এনআইএ তার প্রেস বিবৃতিতে এই প্রথম খোলাখুলি জানিয়ে দিল— প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ, খাগড়াগড়ে অভিযুক্ত এবং তাদের সহকারীরা সকলেই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত উল মুজাহিদিনের (জেএমবি) সদস্য। এর মধ্যে রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবি, বদর-এ আলম ওরফে হাসেম মোল্লা এবং আব্দুল হাকিম ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে। তারা এখানে বসে বাংলাদেশে পাচার করার জন্য আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বানানোর কাজে যুক্ত ছিল। এনআইএ জানিয়েছে, তারা জেএমবি-র কাজকর্মের হদিস পেতে তদন্তে সম্ভাব্য সব ক’টি দিকই খতিয়ে দেখবে। জেএমবি-র পিছনে আর্থিক মদতের উৎসও চিহ্নিত করা হবে।

খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হয় ২ অক্টোবর। ১১ অক্টোবর এনআইএ তদন্তে নামে। এনআইএ সূত্রের খবর, খাগড়াগড়ে হাসান চৌধুরীর বাড়ির দোতলায় সন্ত্রাসবাদীরা বিস্ফোরক, আইইডি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরির পুরোদস্তুর একটি গবেষণাগার গড়ে তুলেছিল। এই গবেষণাগারই এ দিন স্বচক্ষে দেখতে এসেছিলেন ডিজি। খাগড়াগড়ের ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে বাদশাহি রোডের একটি বাড়িতে গত ১৬ অক্টোবর এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড) তল্লাশি চালিয়ে ৩৫টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও চারটি সকেট বোমা উদ্ধার করেছিল। খাগড়াগড় থেকে ডিজি এ দিন যান বাদশাহি রোডের বাড়িতেও। খাগড়াগড়ের মতোই আরও একটি গবেষণাগারের হদিস মিলেছিল মুশির্দাবাদের বেলডাঙাতেও। যে কারণে বর্ধমান থেকে ডিজি হেলিকপ্টারে চলে যান বহরমপুরে এবং সেখান থেকে গাড়িতে পৌঁছন বেলডাঙায়। এনআইএ-র এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “আমাদের ডিজি তিন রকম তিনটি জায়গায় গেলেন। একটি, বিস্ফোরক ও আইইডি-র গবেষণাগার। দ্বিতীয়টি, আইইডি মজুত রাখার জায়গা। তৃতীয়টি খাগড়াগড়ের আগে যেখানে গবেষণাগার ছিল, সেই জায়গা।”

শুক্রবার সকালে বর্ধমানের সাই
কমপ্লেক্সে পৌঁছলেন এনআইএ-র
ডিজি শরদ কুমার। নিজস্ব চিত্র।

তদন্ত সেরে কলকাতা ফিরছেন এনআইএ-র
ডিজি শরদ কুমার। বহরমপুরে
গৌতম প্রামাণিকের ছবি।

এ দিন বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ বিএসএফের হেলিকপ্টারে বর্ধমানের নবাবহাটে স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সাই)-এর মাঠে নামেন ডিজি। সঙ্গে ছিলেন এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহ এবং খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার বিক্রম খালাটে। নবাবহাট থেকে সোজা তাঁরা চলে আসেন খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থলে। দোতলা বাড়িটি খুঁটিয়ে দেখেন এনআইএ-র সর্বোচ্চ কর্তা। ওই বাড়ির মধ্যেই এখনও বেশ কিছু জিনিস রাখা হয়েছে। বাড়িতে ঢোকার মুখে ডিজিকে তৃণমূলের অস্থায়ী পার্টি অফিসটিও দেখান অন্য অফিসারেরা। ডিজি-সহ এনআইএ-র কর্তারা বাড়ির ছাদেও ওঠেন। মিনিট পনেরো ওই বাড়িতে কাটিয়ে ডিজি জানান, তিনি বাদশাহি রোডে রেজাউল করিমের বাড়িটি দেখতে চান। নইলে বাদশাহি রোডে যাওয়া হবে বলে আগে থেকে জেলা পুলিশও জানত না।

এর আগে ১১ অক্টোবর এনআইএ-র তদন্তকারী দল যে দিন বর্ধমানে তদন্তে গিয়েছিল, সে দিন জেলা পুলিশকে সঙ্গে নিয়েই এলাকা পরিদর্শন করেছিল তারা। এ দিন কিন্তু এনআইএ-র দলের সঙ্গে বর্ধমান থানা আইসি আব্দুল গফফর ছাড়া জেলা পুলিশ বা সিআইডি-র আর কেউ ছিলেন না। হেলিপ্যাডে ডিজিকে স্বাগত এবং বিদায় জানাতে অবশ্য পুলিশ সুপার এসএমএইচ মির্জা উপস্থিত ছিলেন। তা ছাড়া হেলিকপ্টার পাহারা এবং ডিজি-র নিরাপত্তার জন্য এ দিন বিএসএফের এক দল জওয়ানের বর্ধমানে আসার কথা ছিল। সেই মতো মালদহ থেকে এ দিন ভোরে জওয়ানরা রওনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ে পৌঁছতে পারেনি। বীরভূম থেকেই তাঁরা ফিরে যান। ডিজি-র হেলিকপ্টার পাহারায় জেলা পুলিশই বহাল ছিল।

এ দিন খাগড়াগড়েও এলাকা কর্ডন করে কড়া পুলিশি ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। পুরো এলাকায় এনআইএ-র তদন্তকারী এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ছাড়া তাই আর কাউকে দেখা যায়নি। ডিজি বেরিয়ে যাওয়ার পর খাগড়াগড়ের বাসিন্দারা বেরিয়ে এসে পুলিশি বাড়াবাড়ি এবং লাগাতার তদন্তের জেরে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে বলে ক্ষোভ উগরে দেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদেরও এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। বাদশাহি রোডে রেজাউলের বাড়িতে মিনিট কয়েক কাটিয়ে ডিজি ফিরে যান নবাবহাটের হেলিপ্যাডে। মুর্শিদাবাদের উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। বেলা ১২ টা ৫৫ মিনিটে বহরমপুর সার্কিট হাউস থেকে তাঁর কনভয় রওনা দেয় বেলডাঙার উদ্দেশে। দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ তিনি পৌঁছন বেলডাঙায়। বড়ুয়া পাওয়ার হাউসপাড়ায় শাকিলের ভাড়া করা ওলিওল ইসলামের বাড়িতে প্রায় ১৫ মিনিট ছিলেন ডিজি। সেখান থেকে তিনি চলে যান ফারাজিপাড়ায় বোরখা তৈরির কারখানায়, ছিলেন মিনিট পাঁচেক। শিশু মাদ্রাসা বাজারে শাকিলের দোকান ‘বোরখা ঘরে’ ডিজি নামেননি। গাড়ি থেকেই দেখে নেন ডেরাটি।

দুপুর সওয়া ২ টো নাগাদ কনভয়ের মুখ ঘুরে যায় বহরমপুরের দিকে। ২টো ৪০ মিনিটে বহরমপুর সার্কিট হাউসে ফিরেই শরদ কুমার বৈঠকে বসেন বিএসএফ-এর ডিআইজি এবং মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপারের সঙ্গে। সূত্রের খবর, ডিআইজি জিতেন্দ্র কুমার রদলা এবং এসপি সি সুধাকরের কাছে সীমান্ত এলাকার অপরাধ নিয়ে খবরাখবর নেন ডিজি। অনুপ্রবেশ, জাল নোটের কারবার, জাল নথি দিয়ে পাসপোর্ট তৈরির চক্র নিয়ে তিনি বিশদ তথ্য চান। সেই সঙ্গে সীমান্তের কতটুকু অংশে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে, কোথায় নেই, সে সব নিয়েও আলোচনা হয়। বিকেল ৩টে ৫ মিনিট নাগাদ তাঁর কপ্টার উড়ে যায় কলকাতার উদ্দেশে।

বিকেলে কলকাতায় ফিরে সল্টলেকের সিআরপি অতিথি নিবাসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শরদ কুমার বলেন, “তদন্ত পর্যালোচনা করার জন্য আমি কলকাতায় এসেছি। মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানে গিয়েছি। এই মামলায় যারা পলাতক, তাদের গ্রেফতার করার জন্য আমরা কিছু কৌশল বার করেছি।” পলাতকদের হদিস দিলে আর্থিক পুরস্কার ঘোষণার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করছে এনআইএ। শীঘ্রই এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য এনআইএ-র ওয়োবসাইটে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সঙ্গে তেলেঙ্গানার করিমনগরে গত ফেব্রুয়ারি মাসের একটি ব্যাঙ্ক ডাকাতির যোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে এনআইএ। ওই ডাকাতির টাকার একাংশ খাগড়াগড়ের জঙ্গিদের কাছে পৌঁছেছিল বলে তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা। কারণ ওই ডাকাতিতে জড়িতরা জেল পালানো সিমি সদস্য বলে সন্দেহ। তা ছাড়া খাগড়াগড়ে উদ্ধার টাকার বান্ডিলে করিমনগরের ব্যাঙ্কের ছাপ মিলেছে বলে খবর। এ দিন এনআইএ-র ডিজিকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব না। কারণ, তাতে তদন্ত প্রভাবিত হবে।” সন্ধেয় সিআরপি-র অতিথিনিবাসে এনআইএ-র অফিসারদের সঙ্গে ফের আলোচনায় বসেন ডিজি। সূত্রের খবর, খাগড়াগড় তদন্তের গতিপ্রকৃতি ছাড়াও এ রাজ্যে এনআইএ-র স্থায়ী ঘাঁটি তৈরির ব্যাপারেও এ দিন আলোচনা হয়েছে।

আসছেন ডোভাল

এনআইএ-র ডিজির পরে রাজ্যে আসছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। আগামী সোমবার তাঁর আসার কথা। সূত্রের খবর, তৃণমূল সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানের জামাত-যোগ এবং সারদার টাকা বাংলাদেশে যাওয়ার অভিযোগ নিয়ে যে সব তথ্য ঢাকা দিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করতে চান ডোভাল। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, পড়শি দেশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতেই আসছেন ডোভাল। তিনি খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্তের অগ্রগতি জানতে বর্ধমানেও যেতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

khagragarh case nia shakil jamat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE