পাড়ুই-মামলার এফআইআরে প্রথম নামটাই তাঁর। কিন্তু চার্জশিটে আদৌ সেই নাম রাখা হবে কি না, সে সম্পর্কে এখনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেনি রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)।
তিনি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। সাড়া জাগানো ওই সাগর ঘোষ হত্যা-মামলায় যাঁকে গ্রেফতার না-করায় আদালতে বারবার সমালোচনার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার।
২০১৩-র ২১ জুলাই, পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুইয়ের কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগরবাবু, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বিস্তর টানাপোড়েনের পরে খোদ কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশ সাগর-হত্যার এফআইআর নেয়, যাতে অনুব্রতের পাশাপাশি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরও নাম রয়েছে। কোর্টের কাছে নিহতের পরিজনদের দেওয়া জবানবন্দিতেও অভিযুক্ত-তালিকায় অনুব্রতের নাম এক নম্বরে। অনুব্রত-বিকাশ অবশ্য এখনও অধরা।
এমতাবস্থায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাড়ুই-তদন্তে বিশেষ দল (সিট) গড়ে দিয়ে হাইকোর্ট রাজ্য পুলিশের ডিজি’কে মূল তদন্তকারী নিযুক্ত করে। পুলিশ-সূত্রের খবর, পাড়ুই মামলার চার্জশিট তৈরি প্রায় সেরে ফেলেছে সিট। কিন্তু চার্জশিটে অনুব্রত মণ্ডলের নাম থাকবে কি না, সে বিষয়ে তদন্তকারীদের মধ্যে ধন্দ রয়েছে। রাজ্য পুলিশের শীর্ষ স্তরেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে পুলিশ-সূত্রের দাবি।
ঘটনাচক্রে, পাড়ুই-তদন্তে পুলিশের ভূমিকা ঘিরেও বিতর্ক দানা বেঁধেছে। সাগরবাবুর পুত্রবধূ শিবানীদেবীর অভিযোগ ছিল, শ্বশুরমশাইকে আহত অবস্থায় ফেলে রেখে পুলিশ জবরদস্তি তাঁদের দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে, এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে ভিত্তিহীন ভাবে তাঁদের গ্রেফতার করে আসল অপরাধীদের আড়াল করেছে। এর পরেই কলকাতা হাইকোর্টে সিআইডি-তদন্তের আর্জি জানিয়ে মামলা দায়ের হয়েছিল, এবং হাইকোর্টই গত ডিসেম্বরে পাড়ুই-মামলার তদন্তভার সিআইডি’র হাতে ন্যস্ত করে। সিআইডি-ও অনুব্রত বা বিকাশকে গ্রেফতারে উদ্যোগী হয়নি। ফের হাইকোর্টে মামলা হয়। রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল জিএমপি রেড্ডিকে মাথায় রেখে সিট গড়ে দিয়ে পুলিশকে তদন্তে নামতে বলেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।
রাজ্য পুলিশ-সূত্রের খবর, পাড়ুই-মামলার এফআইআরে মোট ৪১ জনের নাম রয়েছে। তার প্রথম দু’টি হল অনুব্রত ও বিকাশের। ওঁরা তো গ্রেফতার হনইনি, উপরন্তু এই দশ মাসে ধরা পড়েছেন সাকুল্যে সাত জন। এঁদের দু’জন ভগীরথ ঘোষ ও সজলকান্তি ওরফে সুব্রত রায় হলেন সাগর-হত্যায় অন্যতম মূল অভিযুক্ত। ওঁঁরা যথাক্রমে গত এপ্রিল ও মে মাসে সিউড়ি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। অভিযোগ, আত্মসমর্পণের আগে তাঁরা ঘণ্টা কয়েক আদালত চত্বরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেও পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করার চাড় দেখায়নি। সিট পরে আদালত মারফত হেফাজতে নেয়।
পুলিশ-সূত্রের খবর: ভগীরথ-সুব্রতকে জেরা করার পরে চার্জশিট চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও অনুব্রত ও বিকাশকে গ্রেফতারের বিষয়ে সিটের কর্তা-ব্যক্তিরা উচ্চবাচ্য করেননি। এক তদন্তকারী বলছেন, “গ্রেফতার না-করেও চার্জশিট দেওয়া যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ওঁঁদের ফেরার দেখাতে হবে।” এ দিকে তদন্তকারীদেরই একাংশের দাবি, বিকাশ-অনুব্রতকে ফেরার হিসেবে দেখানো আদৌ সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় পুলিশ-কর্তাদের একটি মহলের অভিমত, গ্রেফতার করা সম্ভব না-হলে চার্জশিট থেকে অনুব্রত-বিকাশের নাম বাদই পড়তে পারে।
কিন্তু সেটাও কি সম্ভব?
এ নিয়ে পুলিশের অন্দরে বিতর্ক রয়েছে। তদন্তকারীদের একাংশের যুক্তি: পাড়ুই-তদন্তে গাফিলতির জন্য সিট-কে একাধিক বার কোর্টের ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। এমনকী, খোদ ডিজি’র কৈফিয়ত চেয়ে তাঁকে হাইকোর্টে তলব করেছিলেন বিচারপতি দত্ত। তাঁর নির্দেশে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশ জারি করলেও বিতর্কের রেশ থেকে গিয়েছে। এ হেন পরিস্থিতিতে চার্জশিটেও যদি অনুুব্রত-বিকাশের নাম না-থাকে, তা হলে বিতর্ক ফের ফুঁসে উঠতে পারে বলে তদন্তকারীদের অনেকের আশঙ্কা।
শেষমেশ কী হতে পারে? পুলিশ-সূত্রে জানা যাচ্ছে, পাড়ুই-চার্জশিট চূড়ান্ত করার আগে সিটের সদস্যেরা বৈঠকে বসবেন। সেখানেই ফয়সালা হবে, চার্জশিটে অনুব্রত ও বিকাশের নাম রাখা হবে কি না। “যা করার, উপরমহলের নির্দেশ মেনে করা হবে।” মন্তব্য এক সিট-কর্তার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy