অনুপ্রবেশকারী-তত্ত্ব নিয়ে তরজা চলছিলই বিতর্কের মুখে তা নিয়ে ব্যাখ্যাও দিচ্ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তারই সঙ্গে এ বার মতুয়াদের অধিকারের প্রশ্নে সরব হয়ে নতুন চাল দিলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। দিল্লিতে ক্ষমতায় এলে তাঁদের সরকার মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেবে বলে আশ্বাস দিলেন তিনি রাজ্যে চতুর্থ দফার ভোটের দিন প্রচারে এসে মোদীর সভা ছিল কৃষ্ণনগর, বারাসত ও কাঁকুড়গাছিতে। দক্ষিণবঙ্গে নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব যথেষ্ট। গত বিধানসভা ভোটের আগে মতুয়া-মন জয়ের লক্ষ্যে তৃণমূল এবং বামের রেষারেষিও বেধেছিল। সাম্প্রতিক সব ভোটের নিরিখে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের সিংহ ভাগ অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দখলে। দক্ষিণবঙ্গের প্রচারে তৃণমূলের ওই ভোটব্যাঙ্ককে নিশানা করতে চেয়েছেন মোদী।
বস্তুত, অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়ে বিজেপি-র যা বক্তব্য, তার সঙ্গেই মতুয়াদের বঞ্চনার প্রসঙ্গ জড়িয়ে নিয়েছেন মোদী। কৃষ্ণনগর এবং বারাসতে দু’টি সমাবেশেই বুধবার মতুয়া-প্রসঙ্গ তুলেছেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। বলেছেন, “মতুয়াদের এখনও ভারতসন্তানের স্বীকৃতি মিলল না। অনুপ্রবেশ করে যাঁরা আসছেন, তাঁরা সব পাচ্ছেন। অথচ মতুয়ারা এখনও নাগরিকত্ব পেলেন না। দিল্লিতে গিয়ে আমি এই অধিকার আপনাদের দেব।” এ দেশে অনুপ্রবেশকারীরা এসে যাবতীয় সুবিধা পাবেন অথচ মতুয়ারা নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন কেন এই ভাবেই বিষয়টি দেখাতে চেয়েছেন মোদী। পরে কাঁকুড়গাছির সভাতেও এই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন তিনি।
মোদীর বক্তব্য, “দিদি আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই, আপনি বাংলাদেশিদের জন্য, ভোটব্যাঙ্কের জন্য মোদীকে জেলে পুরতে চাইছেন। কিন্তু এখানকার মতুয়া সম্প্রদায়ের জন্য কী করছেন? এরা ‘ভারত মা কী জয়’ বলে। ভারতে থাকতে চায়। তাদের কেন ভারতের নাগরিক করলেন না? আমি কথা দিচ্ছি, মতুয়া সম্প্রদায়ের কথা মন দিয়ে শুনে ব্যবস্থা নেব।”
মোদীর এই বক্তব্য অবশ্য নস্যাৎ করে দেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা। মোদীর কাঁকুড়গাছির সভার প্রায় কাছাকাছি সময়ে বেহালায় তৃণমূলের সমাবেশ থেকে মমতা বরং নিজস্ব কায়দায় মোদীকে আক্রমণ করেছেন মতুয়া-প্রশ্নেও। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “ও (মোদী) কি গাধা না ভোঁদা? জানে না কিছুই! ওরা ভারতীয় নাগরিক। মতুয়াদের লক্ষ লক্ষ সমর্থক আছেন। কোত্থেকে নাগরিকত্ব দিবি? ওরা তো হয়েই বসে আছে!” গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে কেন এ ভাবে তুই-তোকারি করছেন, তারও নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “তুমি থেকে তুইয়ে চলে গেলাম। রাজনৈতিক ভাবে ছোট তো, তাই! ওদের (গুজরাত) সাংসদ ২২টা, আমাদের ৪২টা।”
দলনেত্রীর সুরেই বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী তথা সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রতিক্রিয়া, “মতুয়াদের সম্পর্কে মোদীর ধারণা নেই। এ সব কে ডি বিশ্বাসের (বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী) তত্ত্ব। ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করে মতুয়ারা আন্দোলন শুরু করেন। বিজেপি-র করা ওই আইনে ও’পার বাংলা থেকে আসা ২ কোটি মানুষ নাগরিকত্ব হারান। তখন মোদী কোথায় ছিলেন? এত দিন কেন এ সব কথা বলেননি? কাউকে তাড়ানো যাবে না!’’ দীর্ঘ দিন মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “নির্বাচনের ৪-৫ দিন আগে এ সব বলতে হয়। ১৪ বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া মতুয়াদের পাশে কেউ ছিল না।”
বনগাঁর সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাসের প্রতিক্রিয়া, “রাজ্যে প্রচারে এসে মোদী আগে যা বলেছিলেন, তাতে বিজেপি-র ভোট হারানোর সম্ভাবনা ছিল। কে ডি বিশ্বাস নিশ্চয়ই ওঁর কানে সে কথাটা তুলে দিয়েছিলেন। মোদী আজ সেই বক্তব্যেরই ব্যাখ্যা দিলেন।” অন্য দিকে, বিজেপি-র মতুয়া প্রার্থী কে ডি-র বক্তব্য, “রাজ্যে এক কোটিরও বেশি মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ আছেন। চল্লিশ লক্ষের উপরে উত্তরবঙ্গে, বাকিটা দক্ষিণবঙ্গে। ষাট লক্ষেরও বেশি যে মতুয়ারা দক্ষিণবঙ্গে আছে, তাদের প্রায় ৪০%-ই এখনও ভারতের নাগরিকত্ব পাননি। মোদীজি এঁদের কথাই বলেছেন। ক্ষমতায় এলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়াই হবে আমাদের প্রধান কাজ।”
মোদীর মন্তব্য নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে মতুয়া-মহলে। একাংশ বলছেন, রেশন-কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র না থাকা বা ভোটার তালিকায় নাম না থাকা নিয়ে তাঁরা দীর্ঘ দিন আন্দোলন করেছেন। মোদী যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হলে তাঁরা কৃতজ্ঞ থাকবেন। কিন্তু এটা ভোটের চমক কি না, সেই সংশয়ও আছে তাঁদের মনে। মতুয়াদেরই আর এক পক্ষ বলছে, সর্বভারতীয় দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কি জেনে-বুঝে মিথ্যা আশ্বাস দেবেন? এই পক্ষের দাবি, “মোদীর মন্তব্য নিয়েই বিজেপি-কে চাপে ফেলার মতলবে ছিল অন্যেরা। মোদী যা বললেন, তাতে ওঁর আগের কথার ব্যাখ্যা তো হলই। উল্টে বিরোধীদের চাপে ফেললেন উনি!”
প্রসঙ্গত, অনুপ্রবেশ নিয়ে তাঁর আগের কথার স্পষ্ট ব্যাখ্যা এ দিন ফের দিয়েছেন মোদী। বলেছেন, “শরণার্থী যাঁরা, তাঁরা আমাদের পরিবার, আপনজন। তাঁদের দেখভাল আমাদের কাজ। শুধু বাংলা বা অসম নয়, পঞ্জাব, গুজরাত, আমরা সকলে মিলে সামলাব তাঁদের। কিন্তু যাঁরা অনুপ্রবেশকারী, জেনে-বুঝে ভারতে আসছেন, তাঁদের ফিরে যেতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে অনুপ্রবেশ ভারতের উপরে আক্রমণ, সেটা ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।”অনুপ্রবেশ থেকে মতুয়া-প্রশ্নে ঢোকার পথে মোদী কিন্তু রেয়াত করেননি তৃণমূল বা বাম কাউকেই। লোকসভায় ২০০৫-র অগস্টে এই অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়েই তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ মমতা কী কাণ্ড বাধিয়েছিলেন, মোদী অস্ত্র করেছেন সেই ঘটনাকে। তাঁর বক্তব্য, সে সময় মমতা লোকসভায় বলতে চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ সমস্যা গুরুতর। কিন্তু বামেরা এদের ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করছে এ বিষয়ে তাঁকে বলতে দেওয়া হয়নি বলে স্পিকারের আসনের দিকে কাগজ ছুড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন মমতা। তা উল্লেখ করে মোদীর খোঁচা, “সে দিন ভেবেছিলাম, দিদি সত্যি বাঘিনী! বাংলার জন্য একা লড়ছেন। এখন অন্য কথা বলছেন। কেন? অনুপ্রবেশকারীরা এখন আপনার ভোটব্যাঙ্ক হয়েছে বলে?” মোদীর মন্তব্য, “অনুপ্রবেশ নিয়ে ২০০৫-এর অগস্টে সংসদে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন দিদি। ২০১৪-য় দিদির সেই ডায়লগ যেই মোদী বলল, অমনি মোদী অপরাধী হয়ে গেল!”
মমতা অভিযোগও মানতে চাননি। তাঁর জবাব, “আমি নাকি অনুপ্রবেশের সমর্থনে কথা বলেছি! রেশন কার্ডে গাদা ভুয়ো নাম ছিল, যেগুলো বাতিল করতে হবে বলেছিলাম। কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল তখন।” মোদীকে মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষ, “কে অনুপ্রবেশকারী, কিছুই জানে না! ওর মগজে আসলে মরুভূমি!”
সিপিএম এ প্রশ্নে মোদীর খোঁচাকে অস্ত্র করেছে! মোদীর কাঁকুড়গাছির সভার সময়ই হাজরা পার্কে সিপিএমের সভা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “মোদী হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন! ২০০৫-এ আপনি (মমতা) কী করেছিলেন? তখন তৃণমূল-বিজেপি হাত মিলিয়েছিল। আসলে তৃণমূলের নীতি ক্ষমতায় থাকা।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “বাংলাদেশি নিয়ে মোদীর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিতর্ক করছেন। কিন্তু তিনি এনডিএ সরকারের মন্ত্রী থাকার সময় এ নিয়ে টুঁ শব্দটি করেননি। ’৭১-এর পরে যাঁরা ও’পার থেকে এসেছেন, তাঁদের বাংলাদেশে পাঠানো নিয়ে যখন বিল পাশ হয়, তখন বাম- কংগ্রেস বিরোধিতা করলেও তৃণমূল সমর্থন করেছিল।” বিমানবাবুর দাবি, “এখন বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল-বিজেপি মক্-ফাইট করছে। এই বিরহ ভোটের পর মিলনে পরিণত হবে!”
মোদী বামেদেরও বাদ দেননি। কেন্দ্রে ফ্রন্ট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রয়াত সিপিআই নেতা ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ১৯৯৬-৯৭ সালে বলেছিলেন, এখানে এক কোটি বাংলাদেশি আছেন। তা উল্লেখ করে মোদী মনে করিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধবাবু এক বার বলেছিলেন সীমান্তের মাদ্রাসাগুলি দেশের নিরাপত্তার পক্ষে সন্দেহজনক। বুদ্ধবাবু সেই মন্তব্যের জন্য ভুল স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মোদীর প্রশ্ন, “অনুপ্রবেশ নিয়ে বাম-কংগ্রেস সবাই তো ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছে। এখন দিদিও করছেন।”
আক্রমণে কাউকে বাদ না দিলেও ভোটব্যাঙ্কের নিরিখেই মমতা যে তাঁর পয়লা নম্বর নিশানা, তা স্পষ্ট মোদীর কথায়। তিনি বলেন, “দিদি এত বদলে যাবেন ভাবিনি! কুর্সির জন্য নিজের আগের কথা ভুলে গেলেন! অনুপ্রবেশকারীরা চাকরি পাচ্ছেন। বাকিরা ভাবুন, এমন চলতে থাকলে আপনারাই না খেয়ে মরবেন!”
যার প্রেক্ষিতে মমতা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, “তুমি বাংলার কাউন্সিলরও নও! তুমি বাংলার কে? বাংলার মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়ার অধিকার তোমায় কে দিয়েছে? বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে বাংলার মানুষকে তাড়াবে! বাংলার মানুষই তো তোমায় প্রথম তাড়াবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy