মাছে-ভাতে বাঙালি। আর কিছু হোক না-হোক, দু’বেলা দু’টুকরো মাছ পাতে পড়লেই খুশি। অথচ গত পাঁচ বছর ধরে মাছ উৎপাদনে প্রথম স্থানটি পশ্চিমবঙ্গের দখলে নেই। এক নম্বর জায়গাটির দখল নিয়ে রেখেছে অন্ধ্রপ্রদেশ। ২০১১-১২-র পর থেকে বাংলা নেমে এসেছে দু’নম্বরে। অদূর ভবিষ্যতে যে হারানো গৌরব উদ্ধার হবে, তেমন আশাও নেই এই মুহূর্তে। রাজ্য মৎস্য দফতরের হিসেব, পশ্চিমবঙ্গে গত বছর ১৬ লক্ষ টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। অন্ধ্রে ২০ লক্ষ টন। গত সাত বছরে রাজ্যে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ২.২১ লক্ষ টন। অন্ধ্রে বেড়েছে ১২.১৩ লক্ষ টন।
অথচ অন্ধ্রপ্রদেশ একটি দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্য। যেখানে মাছ খাওয়ার চল কম। লেখক বুদ্ধদেব বসু মার্কিন মুলুকে পৌঁছলে প্রথম রাতে তাঁর খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল এক দক্ষিণ ভারতীয়ের বাড়িতে। এ নিয়ে ‘ভোজনশিল্পী বাঙালি’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, সেই রাত প্রায় অভুক্ত থাকতে হয়েছিল। তবে সেটা মেছো বাঙালির জিভের দোষ। আর সেই বাঙালিকেই কি না মাছ উৎপাদনে হারিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণ ভারতের একটি রাজ্য! অন্ধ্রের রুই-কাতলা না এলে চলেই না। বাঙালির পাতে মাছ জোগাতে বছরে গড়ে ৭০ হাজার টন মাছ আনতে হয় অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। অন্ধ্রের মাছের উপরে এই নির্ভরতা অবশ্য বহু বছর ধরেই। তবু তার মধ্যেও রুপোলি রেখা ছিল। মাছ উৎপাদনে এক নম্বর জায়গাটা ছিল পশ্চিমবঙ্গের। পাঁচ বছর ধরে সেটাও নেই।
পশ্চিমবঙ্গে নদী, খালবিল, পুকুর, ভেড়ির অভাব নেই। তবে কেন এই এই অবস্থা? মৎস্য দফতরের এক আধিকারিক বললেন, ‘‘এই রাজ্যে যত জলাশয় রয়েছে, তাতে বছরে ৩০ লক্ষ টন মাছ উৎপাদন হওয়ার কথা, অথচ হচ্ছে মাত্র ১৬ লক্ষ টন।’’
মৎস্য দফতরের একটি সূত্রের মতে, মাছের উৎপাদন ঠিক মতো না বাড়ার পিছনে মূলত দায়ী আধিকারিকের অভাব। রাজ্যে ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে ১২১টি ব্লকে মৎস্য উন্নয়ন আধিকারিকের পদ শূন্য। চার বছর ধরেই এই অবস্থা। আর এই সময়েই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তার এক নম্বর জায়গাটা হারিয়েছে।
প্রশ্ন হল, মাছ চাষ বাড়াবেন তো মৎস্যজীবীরা। সরকারি অফিসারদের কী ভূমিকা?
মৎস্য দফতরের এক কর্তা জানান, নতুন নতুন প্রযুক্তিতে চাষ করার জন্য মৎস্যজীবীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন অফিসাররা। প্রশিক্ষণকেন্দ্রেই থাকে গবেষণাগার। চাষি যেখানে মাছ চাষ করবেন, সেই পুকুর বা জলাশয়ের মাটি ওই গবেষণাগারেই পরীক্ষা করে দেখে সেই মতো চাষের পদ্ধতি ও কৌশল নেওয়া হয়। আবার ওই অফিসাররাই সচেতনতা শিবির আয়োজন করে মাছের নানা নতুন নতুন রোগ সম্পর্কে চাষিদের সজাগ করেন। প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষা দেন। সেই সঙ্গে মাছচাষিদের আর্থিক সুরক্ষায় ঋণের ব্যবস্থাও করেন ওই আধিকারিকরা। ব্যাঙ্কে গিয়ে চাষি হয়রানির শিকার হলে তাঁরা নিজেরা ব্যাঙ্কে গিয়ে সমস্যার সমাধান করেন।
দফতরের এক অফিসারের কথায়, ‘‘১২১টি ব্লকেই যদি এই সব কাজ ঠিকমতো না হয়, তা হলে তার প্রভাব তো রাজ্যের মাছ উৎপাদনে পড়বেই।’’
মৎস্য দফতরের আর একটি সূত্রের খবর, অনেক আধিকারিককে আবার একাধিক ব্লকের দায়িত্ব সামলাতে হয়। এর পাশাপাশি কোথাও কোথাও পড়ুয়াদের সাইকেল বিলি, মিড ডে মিল, জনশিক্ষার কাজও দেখতে হচ্ছে তাঁদের। ফলে খাতায়-কলমে আধিকারিক থাকলেও থাকলেও দফতরের কাজে ফাঁক থেকে যাচ্ছে।
কিন্তু এত জন অফিসারের পদ ফাঁকা পড়ে কেন?
দফতর সূত্রের খবর, আগে নিয়োগ হতো পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ভার দেওয়া হয় স্টাফ সিলেকশন কমিটিকে। এই নিয়ে আইনি জটিলতা চলে দীর্ঘকাল। রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ জানান, মৎস্য উন্নয়ন আধিকারিকদের ৭০টি পদের অনুমোদন মিলেছে। তাঁর আশা, ‘‘সমস্ত ব্লকে ওই পদ পূরণ হয়ে গেলে আমরা মাছ উৎপাদন আরও বাড়াতে পারব।’’
কিন্তু তাতে কি বাংলা আবার মাছের সভায় সেরার আসন নেবে?
উত্তর মিলছে না তার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy