Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
স্যান্ডহেডস থেকে ফিরে

মাঝদরিয়ায় ‘ডাউনলোড’ই এখন নতুন ভরসা বন্দরের

সঙ্কট নাব্যতার। ঢুকছে না বড় জাহাজ। এ বার তাই মাঝসমুদ্রে পণ্য খালাস করেই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর ফলে চলতি আর্থিক বছরে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পণ্য আমদানির পরিমাণ ১৭ শতাংশ বা়ড়তে চলেছে বলে তাঁদের আশা।

পণ্য খালাসের অপেক্ষায় সমুদ্রে নোঙর বিদেশি জাহাজের। স্যান্ডহেডসে কেওপিটি-র জাহাজের ডেক থেকে জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

পণ্য খালাসের অপেক্ষায় সমুদ্রে নোঙর বিদেশি জাহাজের। স্যান্ডহেডসে কেওপিটি-র জাহাজের ডেক থেকে জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

সঙ্কট নাব্যতার। ঢুকছে না বড় জাহাজ। এ বার তাই মাঝসমুদ্রে পণ্য খালাস করেই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর ফলে চলতি আর্থিক বছরে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পণ্য আমদানির পরিমাণ ১৭ শতাংশ বা়ড়তে চলেছে বলে তাঁদের আশা।

কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের (কেওপিটি) চেয়ারম্যান আর পি এস কাহালোঁ বলছেন, ‘‘২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে আমরা ৫ কোটি ৪০ লক্ষ টন পণ্য খালাস করতে পারব বলে মনে করছি।’’ এবং সেটা সম্ভব হতে চলেছে ট্রান্সলোডিং অপারেশন অর্থাৎ গভীর সমুদ্রে পণ্য খালাসের ব্যবস্থাটি সফল হওয়ার কারণে।

২০১৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে ট্রান্সলোডিং-এর কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে তিনটি এলাকায়— স্যান্ডহেডস, কণিকা স্যান্ড এবং সাগরে— ট্রান্সলোডিং চলছে। ২০১৪-১৫তেই কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে পণ্য আমদানির পরিমাণ ১২ শতাংশ বাড়ে। কাহালোঁ জানাচ্ছেন, সে বার ৪ কোটি ৬০ লক্ষ ২৯ হাজার টন পণ্য খালাস করেছিল কেওপিটি। ২০২০-র মধ্যে বৃদ্ধির পরিমাণ ২৫ শতাংশ ছোঁবে বলে বন্দর কর্তৃপক্ষ আশাবাদী।

কলকাতা এবং হলদিয়া দু’টিই নদী বন্দর। বহু দিন ধরেই নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে বড় জাহাজ আসার সমস্যা এই দু’টি বন্দরকে ভোগাচ্ছিল। এমনকী নাব্যতা যদি আরও কমে এবং সেই অনুপাতে বড় জাহাজের সংখ্যাও যদি ক্রমশ কমতে থাকে, তা হলে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছিল। শুধুমাত্র ড্রেজিং‌ করে জলের গভীরতা বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েই যে সমস্যার সমাধান হবে না, সেটা বুঝতে পারছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিকল্প হিসেবে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির প্রস্তাবের পাশাপাশি ট্রান্সলোডিং অপারেশন শুরু করার ভাবনা সেই সূত্রেই।

ট্রান্সলোডিং কী? যে সব বড় জাহাজ নাব্যতার অভাবে কলকাতা বা হলদিয়া বন্দর অবধি পৌঁছতে পারবে না, তাদের জন্য গভীর সমুদ্রেই পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করে দেয় ট্রান্সলোডিং অপারেশন। পিপিপি মডেল অনুসরণ করে এই কাজে কেওপিটি-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছে জিন্দল আইটিএফ। ২৫০ কোটি টাকা লগ্নি করেছে তারা। জিন্দল আইটিএফ-এরই এমভি যুগলরাজ এবং এমভি ভিগনরাজ নামে দু’টি ট্রান্সলোডার এখন কাজ সামলাচ্ছে। এরা একসঙ্গে অনেকগুলো ক্রেনের সাহায্যে বড় জাহাজ থেকে নির্বিঘ্নে পণ্য খালাস করতে পারে এবং সেই পণ্য ওই সব ক্রেনের সাহায্যেই ছোট জাহাজে তুলেও দিতে পারে। ২০১৩ থেকে এখনও অবধি ১৭টি বড় জাহাজে ট্রান্সলোডিং চালানো হয়েছে। পণ্য নেমেছে ১২ লক্ষ ১৭ হাজার ২৪৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বর্ষার সময় ৫টি জাহাজের পণ্য খালাস হয়েছে ওডিশায় পারাদীপ বন্দর এলাকার কণিকা স্যান্ডে (এখানে পণ্য খালাসের বিশেষ অনুমোদন পেয়েছে কেওপিটি)। বাকি ১২টি জাহাজ মালপত্র খালি করেছে স্যান্ডহেডস-এ। বছরের প্রথম ছ’মাস কণিকা এবং পরের ছ’মাস স্যান্ডহেডে অপারেশন চলবে বলে ঠিক হয়েছে। এই মুহূর্তে ১৮ নম্বর জাহাজ নেভিয়স স্কাই নোঙর করে রয়েছে কলকাতা থেকে ১২৭ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে স্যান্ডহেডস-এ। বঙ্গোপসাগরের গভীরতা সেখানে প্রায় ৪০ মিটার।

কেওপিটি-র সার্ভে জাহাজ এমভি সরোজিনীতে সওয়ার হয়ে এই কর্মকাণ্ড দেখার সুযোগ পেয়েছিল সংবাদমাধ্যম। সরোজিনীর ক্যাপ্টেন বি বি মৈত্র এবং চিফ অফিসার কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, নেভিয়স স্কাই-এর মতো জাহাজ আড়াআড়ি ২২৯ মিটারের মতো লম্বা। জলের উপরিতল থেকে জলের নীচে জাহাজের ভিত (জাহাজি পরিভাষায় একে বলা হয় ড্রাফ্ট) প্রায় ১৪ মিটার দীর্ঘ। ৭৬ হাজার ৯৯৯ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে এসেছে সে। কলকাতা বা হলদিয়া বন্দরে ভিড়তে হলে কিন্তু জাহাজটিতে ২০-২৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি পণ্য রাখা যেত না।

ট্রান্সলোডিং অপারেশন পুরোদমে শুরু হওয়ার আগে তবে কী করা হতো? বন্দর সূত্রের খবর, ২০-২৫ হাজার মেট্রিক টন অবধি পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে ঢুকত। তার চেয়ে বেশি পণ্যবাহী জাহাজকে সাগরে দাঁড় করিয়ে কিছু মাল খালাস করে জাহাজটিকে হালকা বানিয়ে নেওয়া হতো। ছোট মাপের সেই ট্রান্সলোডিং-কেই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এখন আরও বড় আকার দিয়েছে বন্দর। স্যান্ডহেড এবং কণিকা স্যান্ডে ৭০-৭৫ হাজার মেট্রিক টনের জাহাজ খালি করা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। মাঝসমুদ্রে কয়লা নামিয়ে ভেসেল মারফত নদী বেয়ে সোজা ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু গভীর সমুদ্রে লম্বা সময় ধরে নোঙর করে থেকে ট্রান্সলোডার দিয়ে পণ্য খালাস করার এই প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক ভাবে কতটা কার্যকরী? প্রশ্ন উঠতেই পারে, কণিকা স্যান্ডে মাঝসমুদ্রে মাল নামানোর চেয়ে বড় জাহাজ তার অল্প দূরে পারাদীপ বন্দরেই চলে যেতে চাইবে না কেন? এটাই যে কেওপিটি-র কাছে আসল চ্যালেঞ্জ, সেটা মানছেন বন্দর কর্তৃ়পক্ষ। কাহালোঁর কথায়, ‘‘আমরা হিসেব করে দেখেছি, মাঝসমুদ্র থেকে নিকটবর্তী রেললাইন পর্যন্ত মাল পরিবহণের খরচ টন প্রতি হাজার টাকার মধ্যে বেঁধে রাখতে পারলে গোটা বিষয়টা অর্থনৈতিক ভাবে লাভদায়ক থাকবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE