Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মাটির বাঁধ উজিয়ে ভোট দিয়ে যান ওঁরা

ভাদ্রের ভরা বেলায় খাঁ খাঁ করছে উত্তরপাড়া। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁঠাল-জামরুলের ছায়া। গ্রামের বুক চিরে ধুলো ঢাকা একটা আদ্যন্ত মেঠো রাস্তা এঁকেবেঁকে ঠোক্কর খেয়েছে যেখানে, গ্রামের লোকজন চিনিয়ে দেন, ‘অবতারের ভেড়ি’। মানে? মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উত্তরপাড়ার মাঝবয়সী মহিলা বলেন, “আমাগো দ্যাশে যেমন কাঁটাতার, বাংলাদ্যাশের তেমনই অবতার কোম্পানির বাঁধ।”

নির্মল বসু
ঘোজাডাঙা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:০৩
Share: Save:

ভাদ্রের ভরা বেলায় খাঁ খাঁ করছে উত্তরপাড়া।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঁঠাল-জামরুলের ছায়া। গ্রামের বুক চিরে ধুলো ঢাকা একটা আদ্যন্ত মেঠো রাস্তা এঁকেবেঁকে ঠোক্কর খেয়েছে যেখানে, গ্রামের লোকজন চিনিয়ে দেন, ‘অবতারের ভেড়ি’। মানে?

মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উত্তরপাড়ার মাঝবয়সী মহিলা বলেন, “আমাগো দ্যাশে যেমন কাঁটাতার, বাংলাদ্যাশের তেমনই অবতার কোম্পানির বাঁধ।” মহিলা জানান, ওই মাটির বাঁধই দু-দেশের সীমানা রক্ষা করছে। মাটির বাঁধে কি সীমান্ত রক্ষা হয়? হেসে ফেলেন তিনি। রাখঢাক না রেখেই বলেন, “যা বোঝার বুইঝ্যা নেন কর্তা। মাটির বাঁধে কি মানুষের চলাচল রোখা যায়?”

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা আর বসিরহাট ১ নম্বর ব্লকের মাঝে ওই অবতারের বাঁধেই ঠোক্কর খাচ্ছে ভারতের শেষ ভূখণ্ড ঘোজাডাঙার উত্তরপাড়া। স্থানীয় বাসিন্দারা অকপটেই জানান, পাখ-পাখালির মতোই দু-গাঁয়ের লোক ‘হরবখত’ পারাপার করেন। ভোটের সকালেও তার বিরাম নেই। মাঝে মাঝে বিএসএফের নিয়মরক্ষার তদারকি। তাতে অবশ্য থোড়াই তোয়াক্কা করেন ওপারের মানুষ।

শনিবার সকালে যেমন, বাঁধ পার হয়ে এ পারে পা রাখতেই উত্তরপাড়ার আটপৌরে বুথ, গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের সামনে এক চিলতে ছায়ায় দাঁড়ানো বিএসএফ কর্মী হুঙ্কার ছাড়েন, “হল্ট।” সদ্য কিশোরীকে নিয়ে এ পারে আসা মহিলা থমকালেন বটে, তবে নিমেষে ব্যাগ থেকে ভোটার কার্ড বের করে সপ্রতিভ ভাবেই জানিয়ে দিলেন, “ভারতের ভোটার কার্ড আছে দেখবেন নাকি?” জানান, নাম জ্যোৎস্না মণ্ডল, সঙ্গে মেয়ে রিম্পা। দক্ষিণেশ্বরে বাপের বাড়ি। ভারত ভূখণ্ডের এই উত্তরপাড়ায় শ্বশুরবাড়ি, সেখানেই যাচ্ছেন তিনি।

মুচকি হাসেন বিএসএফ কর্মী, “বাপের বাড়ি দক্ষিণেশ্বরে, আর ভোট দিতে এসেছেন এখানে!”

বিএসএফের মতোই উত্তরপাড়া এ ঘটনায় অবাক হয় না। বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক পাশ থেকে ফোড়ন কাটেন, “হাঁটা পথে অবতার ভেড়ি পেরিয়ে ঢুকে পড়লেই হল, কে আটকাচ্ছে? ওঁরা দু’দেশেরই বাসিন্দা, ভোটার কার্ডও আছে উভয় দেশেরই।” বাস্তবিকই তাই। নির্বাচনের সকাল থেকেও তা ঠারেঠোরে মালুম হল। উত্তরপাড়ার গফুর গাজি, মানিক মণ্ডলরা বলেন, “এখন এ সব দেখে কিছুই বুঝবেন না। রাতে আসুন। দেখবেন কেমন, হাজার হাজার গরু ফলন্ত ধান মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ও পারে।” প্রতিবাদ করেন না?

--“খেপেছেন? পাচারকারীদের বিরুদ্ধে গেলে এখানে থাকার জো থাকবে? পুলিশ-সীমান্ত বাহিনীকে জানিয়েও কিস্যু হয় না। হুমকি দেবে। উত্তরপাড়ার কেউ তাই এ সব নিয়ে মাথা ঘামায় না।” ভোটের দিনও ‘ওঁদের’ (বাংলাদেশের বাসিন্দা) দলে দলে আসা রোখা যায় না। ভোট দিয়ে ‘নির্বিঘ্নে’ ফিরে যান। উত্তরপাড়ার অভিযোগ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘ওঁদের’ এমনই ‘বন্দোবস্ত’। আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গেই বুথের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে স্থানীয় এক পুলিশ কর্মী। বলছেন, “দক্ষিণদাঁড়ির বাসিন্দাদের আটকানোর উপায় আছে? ওঁদের প্রায় সকলের কাছেই রয়েছে দু-দেশের ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড। প্রমাণ চাইলেই বের করে দেন।” তাঁরও দাবি, নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে এ সবই ‘তৈরি’ করে দেন রাজনীতির দাদারা। তিনি বলেন, “এটাই চালু নিয়ম।”

ইছামতী পার হয়ে পুরনো সাতক্ষীরা রোড পেরিয়ে পৌঁছনো গেল শিবহাতি অঞ্চলে। ছবিটা সেখানেও একইরকম। রাস্তার দু-ধারে খাঁ খাঁ করছে বুথ। সর্বত্রই জনা পাঁচেক আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান ছায়া খুঁজে এলিয়ে বসে রয়েছেন। বলছেন, “ভোটার না থাকলে ভাল লাগে না। আগেও কয়েকবার এসেছি। এতটা ফাঁকা দেখিনি।” সীমান্ত ঘেঁষা এই সব অঞ্চলেরও অভিযোগ একই। বৈধ ভোটার কারা, সে সমস্যার সমাধান হয়নি আজও। ‘ওঁদের’ আনাগোনা তাই অবাধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE