Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মারাত্মক অস্ত্রের সামনে নিরস্ত্র পুলিশ কেন

কর্তার যুক্তি নিয়ে তর্ক ওঠালেন কর্মীরাই। যাদবপুর-কাণ্ডে পুলিশ কমিশনারের দাবি শুনে বাহিনীর অন্দরে এখন প্রশ্ন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেই রাতে ‘মারাত্মক অস্ত্র’ নিয়ে বহিরাগতেরা যদি সত্যিই ছিল, তা হলে লালবাজার সব জেনেশুনে ‘নিরস্ত্র’ পুলিশকর্মীদের তাদের মুখে ঠেলে দিল কেন? কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বৃহস্পতিবার দাবি করেছেন, মঙ্গলবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে কিছু বহিরাগত ছিলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩২
Share: Save:

কর্তার যুক্তি নিয়ে তর্ক ওঠালেন কর্মীরাই। যাদবপুর-কাণ্ডে পুলিশ কমিশনারের দাবি শুনে বাহিনীর অন্দরে এখন প্রশ্ন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সেই রাতে ‘মারাত্মক অস্ত্র’ নিয়ে বহিরাগতেরা যদি সত্যিই ছিল, তা হলে লালবাজার সব জেনেশুনে ‘নিরস্ত্র’ পুলিশকর্মীদের তাদের মুখে ঠেলে দিল কেন?

কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বৃহস্পতিবার দাবি করেছেন, মঙ্গলবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতরে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে কিছু বহিরাগত ছিলেন। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ওখানে পাঠানো পুলিশের হাতে লাঠি ছিল না। এমনকী, পুলিশকে হেলমেট পরতেও নিষেধ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন লালবাজারের একাধিক শীর্ষ কর্তা। কিন্তু পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের এমন নিধিরাম অবস্থায় ‘মারাত্মক অস্ত্রধারীদের’ সামনে পাঠিয়ে কর্তারা কি তাঁদের চরম বিপদের মুখে ঠেলে দেননি?

খাস লালবাজারের অলিন্দেই এখন প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে। কলকাতার প্রাক্তন কয়েক জন পুলিশ কমিশনারও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। কী রকম?

পুলিশ-সূত্রের খবর: বাহিনীর পরিভাষায় ‘অস্ত্র’ ও ‘মারাত্মক অস্ত্র’-র মধ্যে তফাৎ রয়েছে। অস্ত্র বলতে ছোরা, ছুরি, লাঠিকেও বোঝায়। মারাত্মক অস্ত্র মানে আগ্নেয়াস্ত্র। কলকাতা পুলিশের বহু মাঝারি স্তরের অফিসারের বক্তব্য: পুলিশ কমিশনারের দাবি মানলে ওই রাতে ক্যাম্পাসে কিছু বহিরাগত একে-৪৭ না-হলেও রিভলভার, পিস্তল, নিদেনপক্ষে ওয়ান শটার বা পাইপগান নিয়ে হাজির ছিল। সে সবের গুলিতে একাধিক পুলিশ হতাহত হতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক থেকে শুরু করে আন্দোলনরত পড়ুয়ারাও জখম হতে পারতেন। অথচ সিপি-ই জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে যাওয়া


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

বাহিনীর ন্যূনতম প্রতিরোধের সরঞ্জাম, অর্থাৎ হেলমেট-ও যেমন ছিল না, তেমন প্রত্যাঘাতের ন্যূনতম হাতিয়ার, অর্থাৎ লাঠিও ছিল না।

এমতাবস্থায় এক অভিজ্ঞ ইনস্পেক্টরের প্রশ্ন, “কর্তারা যদি খবরই পেয়ে থাকেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে বহিরাগতেরা রয়েছে, তা হলে কোন ভরসায় লাঠি-হেলমেট ছাড়া ফোর্স পাঠানো হল?” মঙ্গলবার রাতের অভিযানে থাকা এক কনস্টেবলের দাবি, “আমাদের কাছে এমন খবর ছিলই না। সশস্ত্র বহিরাগতেরা রয়েছে জানলে আমরা কখনওই নিরস্ত্র হয়ে যেতাম না।”

গত বছর গার্ডেনরিচে কলেজ ভোটের হাঙ্গামায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সাব ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী। সেই স্মৃতি পুলিশের নিচুতলায় টাটকা। যাদবপুর-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে ওদের কাছে তা আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। উত্তর কলকাতার এক থানায় নিযুক্ত এক সাব ইনস্পেক্টরের কথায়, “তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর পরে আমরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলাম। তার রেশ না-কাটতেই যাদবপুরে সশস্ত্র বহিরাগতদের মোকাবিলায় নিরস্ত্র বাহিনী পাঠানো হল! আমরা ফের বিপন্ন বোধ করছি।” কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের প্রশ্ন, “অস্ত্র থাকার খবর কি গোয়েন্দাদের? তা হলে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? ধৃতদের থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়েছে বলে তো শুনিনি!” তুষারবাবু এ-ও জানতে চান, “কোথায় গেল সশস্ত্র বহিরাগতেরা? ওরা কেন ঢুকেছিল? কাকে মারতে? পুলিশকে, নাকি ছাত্র-ছাত্রীদের, নাকি উপাচার্যকে?” নিরস্ত্র পুলিশকে সশস্ত্র বহিরাগতদের মুখে ঠেলে দেওয়ার সমালোচনা করে আর এক প্রাক্তন সিপি নিরুপম সোমের মন্তব্য, “পুলিশের ঘরেও স্ত্রী-সন্তান থাকে। তাই অভিযানকারী পুলিশকর্মীদের যথাযথ সুরক্ষা জরুরি।”

বর্তমান পুলিশ কমিশনার কী বলেন? এ দিন যোগাযোগ করা হলে সুরজিৎবাবু এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেছেন, “ওই রাতে ঘটনাস্থলে থাকা কয়েক জন অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম কমিশনারের রক্ষীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। যাদবপুর থানার ওসি-র কাছেও সম্ভবত আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।” কিন্তু মারাত্মক অস্ত্রধারীদের মোকাবিলায় তা আদৌ যথেষ্ট ছিল না বলে জানিয়েছেন লালবাজারের অনেকে। উপরন্তু শীর্ষ অফিসারটি নিজেও স্বীকার করেছেন, ঘেরাও তুলে উপাচার্যকে উদ্ধার করতে যাঁদের পাঠানো হয়, তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। সেই বাহিনীতে ছিলেন প্রায় একশো পুলিশ।

এবং ওই বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রেও পুলিশি-শাস্ত্র যথাযথ মানা হয়নি বলে অভিযোগ। কেন?

লালবাজার-সূত্রের ব্যাখ্যা: কোথাও কিছু ব্যক্তি ‘মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র’ নিয়ে জড়ো হয়েছে, এমন খবর পাওয়া গেলে পুলিশ ধরে নেয়, তাদের উদ্দেশ্য সংঘর্ষ-হাঙ্গামা বাঁধানো। পুলিশি নিয়মবিধি অনুযায়ী, এ জাতীয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় ত্রিস্তরীয় ব্যূহ রচনা করতে হয়। যার একেবারে সামনে থাকে হেলমেট-পরা, ঢাল ও লাঠিধারী পুলিশ। তারা ব্যর্থ হলে দায়িত্ব বর্তায় দ্বিতীয় স্তরে মোতায়েন বাহিনীর হাতে। প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র ছুড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে তারা, যে কারণে তাদের হাতে থাকে গ্যাস গ্রেনেড, টিয়ার গ্যাস-গান, রাবার বুলেট বা ছড়রা। তারাও ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি সামলানোর ভার বন্দুকধারী পুলিশবাহিনীর, যারা থাকে শেষ স্তরে। অভিযোগ, যাদবপুরের ক্ষেত্রে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও এ হেন সুসংহত পুলিশি ব্যূহ তৈরি করা হয়নি।

‘যাদবপুর অভিযানে’ সামিল পুলিশের একাংশের চটি-চপ্পলের দিকেও আঙুল উঠেছে। অভিযোগ, মঙ্গলবার রাতে পড়ুয়াদের মারধর ও ছাত্রীদের শ্লীলতাহানিতে সাদা পোশাকের কিছু পুুলিশ চটি পরে এসেছিলেন। লালবাজারের অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান অফিসারদের অনেকে বলছেন, “পড়ুয়ারা যাতে বেশি উত্তেজিত না-হয়ে পড়েন, সে জন্য সাদা পোশাকের পুলিশ পাঠানোর যুক্তি যদিও বা মেনে নেওয়া যায়, চটি-চপ্পল কোনও মতেই মানা যায় না।”

কেন যায় না? পুলিশি নিয়মবিধির প্রসঙ্গ তুলে এই মহলের বক্তব্য: ছদ্মবেশে খবর সংগ্রহের তাগিদ থাকলে অন্য কথা। কিন্তু যেখানে ঝামেলা থামানোই মূল লক্ষ্য, সেখানে সাদা পোশাকের পুলিশের পায়েও বুট কিংবা স্নিকার্স, না-হলে অন্তত কেড্স থাকতে হবে। চটি বা চপ্পল কখনওই নয়। কেননা তাতে পুলিশেরই নিরাপত্তাহানির আশঙ্কা। চটি-চপ্পল যখন তখন পিছলে যেতে পারে। ভারসাম্য হারিয়ে চোট লাগতে পারে।

সব মিলিয়ে সিপি’র বক্তব্যে ধন্দে পড়েছেন বাহিনীরই অনেকে। ওঁদের দাবি, মারাত্মক অস্ত্রের তত্ত্ব মানলে বলতে হয়, প্রাথমিক পুলিশি-বিধি পুলিশই মানেনি। “তাই ওই তত্ত্বের সত্যতা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ থাকছে।” বলছেন কলকাতা পুলিশের এক সাব ইনস্পেক্টর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE