Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সিদ্ধির খোঁজে এ বার ছুটছে আম-বাঙালিও

বারো মাসে বাঙালির এখন চোদ্দো পার্বণ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাল, শুক্রবার সন্ধেবেলা টেলিভিশন অভিনেত্রী রণিতা ওরফে বাহার বাড়িতে প্রতি বছরের মতোই যাবেন। সিদ্ধিদাতার আশীর্বাদ নিতে। এখনও পর্যন্ত তেমনই খবর। আজ বিকেলে ব্যস্ত প্রাক্তন ফুটবলার চুনী গোস্বামীও।

কুমোরটুলি থেকে প্যান্ডেলের পথে গণপতি। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।

কুমোরটুলি থেকে প্যান্ডেলের পথে গণপতি। বৃহস্পতিবার।—নিজস্ব চিত্র।

ইন্দ্রনীল রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৬
Share: Save:

বারো মাসে বাঙালির এখন চোদ্দো পার্বণ।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাল, শুক্রবার সন্ধেবেলা টেলিভিশন অভিনেত্রী রণিতা ওরফে বাহার বাড়িতে প্রতি বছরের মতোই যাবেন। সিদ্ধিদাতার আশীর্বাদ নিতে। এখনও পর্যন্ত তেমনই খবর।

আজ বিকেলে ব্যস্ত প্রাক্তন ফুটবলার চুনী গোস্বামীও। উনি যাচ্ছেন উত্তর কলকাতায়, ‘মঙ্গলমূর্তি’র উদ্বোধন করতে। আর আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের আগামিকালের ডায়েরি তো একেবারে ঠাসা। দক্ষিণ কলকাতার ১৮টা প্যান্ডেলে ‘বিঘ্নহর্তা’র উদ্বোধন রয়েছে তাঁর প্ল্যানারে।

হ্যাঁ, কলকাতার নতুন পার্বণ শুরু হচ্ছে কাল থেকে।

গণেশ পুজো।

বহু দিন ধরেই বাঙালির শারদোৎসবের কাউন্টডাউন শুরু হয় বিশ্বকর্মা পুজো থেকে। কিন্তু এই বছর গণেশ পুজোর যা রমরমা, তাতে দুর্গাপুজোর ঘণ্টা বেজে যাচ্ছে আগামিকাল থেকেই। গত দু’বছর ধরেই গণেশ পুজো ধীরে ধীরে বাড়ছিল কলকাতায়। কিন্তু এই বছর সব রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে। খড়দহ থেকে দক্ষিণ শহরতলির বারুইপুর, বালিগঞ্জ থেকে বৌবাজার কলকাতা শহরে এ বার আরও জাঁকিয়ে বসেছেন সিদ্ধি বিনায়ক।

হঠাৎ হল কী বাঙালির?

বাঙালি যে হুজুগপ্রিয় আর উৎসবমুখী, তা সর্বজনবিদিত। এটা কি তারই প্রতিফলন? নাকি এর পেছনে রয়েছে আরও কোনও সমাজতাত্ত্বিক কারণ? দিল্লি নিবাসী সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দী মনে করেন, “বাঙালি আজ অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ‘ক্রসকালচার’-এ।” তিনি জানালেন, কলকাতায় এখন ধনতেরস হয়। গণেশ পুজোতেও হইহই।

তার একটা কারণ, বলিউড ছবি বা টিভি সিরিয়ালে গণেশ পুজোর জনপ্রিয়তা। “বাঙালি অনেক বেশি ‘সোশ্যালি মুভেবল’ হয়ে গিয়েছে। কলকাতার বহু মানুষ পশ্চিম ভারতে কাজ করেন। অনেকে আবার ফিরেও আসেন। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন সেই কালচারটা। এবং এটা আরও বাড়বে,” বললেন আশিসবাবু।

এটা যে ক্রমশ বাড়ছে, সেটা কুমোরটুলি বা পটুয়াপাড়ায় গেলেই বোঝা যাচ্ছে। অভিনেতা যিশু সেনগুপ্তর বাড়িতে গত চার বছর ধরে গণেশ পুজো হয়। কিন্তু গত কাল কালীঘাটে ঠাকুর কিনতে গিয়ে চমকে গিয়েছেন যিশুর স্ত্রী নীলাঞ্জনা। ছোটবেলা থেকে মুম্বইয়ে গণেশ চতুর্থীর আবহেই বড় হয়েছেন তিনি। কিন্তু কলকাতায় তো আর তেমন মেজাজ নয়, “চার বছর আগেও আমি দেখেছি পাঁচ থেকে দশটা ঠাকুর বিক্রি হচ্ছে,” বললেন তিনি। সেই ছবি এখন অতীত। নীলাঞ্জনার মন্তব্য, “গত কাল দেখলাম অন্তত পাঁচশোরও বেশি গণেশ মূর্তি এক ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল। সঙ্গে সে রকম ভিড়।”

কুমোরটুলিতেও একই অবস্থা। সেখানকার লোকজনের সঙ্গেও কথা বলে জানা গেল, অন্তত ১২০০ গণেশ মূর্তি বিক্রি হয়েছে এ বছর। “কখনও সেটা এক ফুট। কখনও মুম্বইয়ের মতো পনেরো ফুটের। ভাববেন না শুধু মারোয়াড়িরাই কিনছেন। অনেক বাঙালি এখন গণেশ পুজো করছেন,” বললেন কুমোরটুলির নাম-করা শিল্পী নবকুমার পাল। তাঁর কাছে আবার জানা গেল, গণেশ পুজোর এই রমরমায় ক্ষতি হচ্ছে বিশ্বকর্মা মূর্তির। কথায় কথায় নববাবু জানালেন, এত দিন বিশ্বকর্মার মূর্তি গড়েই পুজোর টাকা জোগাড় করতেন। এখন সেই জায়গা অনেকটাই নিয়ে নিচ্ছে গণেশ মূর্তির চাহিদা। “গণেশ পুজোর বাজেট যে রকম বাড়ছে, তাতে আমরা সবাই গণেশ মূর্তি তৈরিতেই মন দিচ্ছি বেশি। ব্যবসায়িক দিক থেকেও লাভবান হচ্ছি। আর সেটা করতে গিয়ে বিশ্বকর্মার মূর্তি আর কেউ সে ভাবে বানাচ্ছেই না,” বলছেন নববাবু।

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের বক্তব্য, বাঙালির এই ‘বিনায়ক-প্রেম’ অনেক দিনই। কিন্তু ইদানীং তা রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর পেয়েছে। গণেশ চতুর্থীতে বাঙালির মাতামাতি খুঁটিপুজোর মতোই নতুন ফেনোমেনা, মত প্রশান্তবাবুর। বললেন, “ছোটবেলায় হাতিবাগান বা মানিকতলা বাজারে দেখেছি পয়লা বৈশাখের দিন গণেশ ঠাকুর বিক্রি হতো। কিন্তু আজকাল গণেশ চতুর্থীতেও বাঙালির হইচই। সেখানে রাজনৈতিক মুখ দেখতে পাই। আশ্চর্য হব না আরও কিছু দিন পরে এই গণেশ পুজোগুলোও এক এক জন নেতার মদতপুষ্ট হয়ে ওঠে।” তাঁর পর্যবেক্ষণ, সিপিএম আমলেও পুজো হত। কিন্তু এতটা খোলাখুলি নয়। কারণ ‘সাংগঠনিক নিষেধাজ্ঞা’ ছিল।

তবে গণেশ পুজো ঘিরে রাজনীতির অঙ্গনে সম্প্রতি যে একটা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে, তা নজরে এসেছে অনেকেরই। তৃণমূলের অন্দরের খবর, এ রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে দল এখন হাতিয়ার করছে এই পুজোকেই। বিশেষ করে অবাঙালিদের কাছে পৌঁছতে গণেশ পুজোয় নেতানেত্রীদের যোগদানে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। নিজ উদ্যোগে পুজো শুরুর কথাও বলা হচ্ছে কোথাও কোথাও। তাই সন্দেহ নেই, রাজ্যে গণেশ পুজোর সংখ্যা আরও বাড়বে।

অবশ্য এ সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না খড়দহের ‘আমরা’ ক্লাবের সন্দীপ ভদ্র বা নেতাজীনগরের পুজোকর্তা অরুণ রায়। “পাড়ার সবাই দুর্গাপুজোয় জড়িত হতে পারেন না। তাঁদের আমরা গণেশ পুজোয় ডেকে নিই,” বলছেন রহড়ার সন্দীপবাবু।

সব মিলিয়ে হয়তো আর কিছু দিনের মধ্যেই মুম্বইয়ের মতো এ শহরের অলিগলি থেকেও ভেসে আসবে ‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া...।’ এ বছর থেকেই সেটা স্পষ্ট। তবে তাতে বাঙালির বা এ রাজ্যের কতটা ‘সিদ্ধিলাভ’ হবে, তা বোধহয় জানেন স্বয়ং সিদ্ধিদাতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ganesh chaturthi mamata bandyopadhayay indranil roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE