Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সারদায় বকেয়া ৫৭ লক্ষ, কোমায় ব্যবসায়ী

পার্ক স্ট্রিটের একটি নার্সিংহোমের কেবিনে শুয়ে রয়েছেন বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। নাকে-মুখে তাঁর অক্সিজেনের মুখোশ। খোলা চোখের শূন্য দৃষ্টি কেবিনের সিলিংয়ে আটকে। চিকিৎসার পরিভাষায়, সেরিব্রাল অ্যাটাকে কোমা-য় চলে গিয়েছেন তিনি। চিকিৎসায় তিনি সাড়া দিচ্ছেন না বলে ডাক্তারেরা জানিয়েছেন।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৪ ০৩:২০
Share: Save:

পার্ক স্ট্রিটের একটি নার্সিংহোমের কেবিনে শুয়ে রয়েছেন বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। নাকে-মুখে তাঁর অক্সিজেনের মুখোশ। খোলা চোখের শূন্য দৃষ্টি কেবিনের সিলিংয়ে আটকে। চিকিৎসার পরিভাষায়, সেরিব্রাল অ্যাটাকে কোমা-য় চলে গিয়েছেন তিনি। চিকিৎসায় তিনি সাড়া দিচ্ছেন না বলে ডাক্তারেরা জানিয়েছেন।

তাঁর নাম সঞ্জয় মণ্ডল। বেহালার ভাটিপাড়া রোডের ওই বাসিন্দা অন্য মালিকদের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে সারদা-র বিভিন্ন সংস্থায় ভাড়া খাটাতেন। তাঁর পরিবারের দাবি, সারদা-র ব্যবসা বন্ধের সময় সঞ্জয়বাবুর বকেয়া পাওনা ছিল ৫৭ লক্ষ টাকা। একে তো সেই পাওনা আদায়ের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। উল্টো দিকে, যাঁদের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি সারদাকে দিতেন, বকেয়া মেটানোর জন্য তাঁরাও লাগাতার চাপ দিচ্ছিলেন। সঞ্জয়বাবুর পরিবারের দাবি, এই চাপ সহ্য করতে পারেননি তিনি। এরে পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

মানসিক চাপে কারও কি এই অবস্থা হতে পারে? এসএসকেএম হাসপাতালের প্রাক্তন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ কল্যাণব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “মানসিক চাপ সহ্যের মাত্রা ছাড়ালে সেরিব্রাল অ্যাটাক হতেই পারে।”

সঞ্জয়বাবুর চিকিৎসা করতে গিয়ে কার্যত নিঃস্ব অবস্থা তাঁর পরিবারের। এর মধ্যেই খরচ দশ লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছে। এর কিছুটা শোধ করেছেন তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা। তা সত্ত্বেও নার্সিংহোমে প্রায় চার লক্ষ টাকা বাকি পড়েছে। গাড়ি মালিকদের কাছে দেনা ও স্বামীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে সঞ্জয়বাবুর স্ত্রী পরমাদেবী তাঁর সমস্ত গয়না বিক্রি করেছেন। সঞ্চয়ও সব শেষ। বেহালার বসতবাড়িটি শুধু অবশিষ্ট রয়েছে। সঞ্জয়বাবুর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেদের বয়স যথাক্রমে বারো, আট ও ছ’বছর। মেয়ের বয়স পনেরো। বছরখানেক ধরে তাদের পড়াশোনা বন্ধ। আত্মীয়-বন্ধুদের সাহায্যে কোনও রকমে স্বামীর চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ সামলাচ্ছেন পরমাদেবী।

কী ভাবে সারদার সঙ্গে ব্যবসা চালাতেন সঞ্জয়বাবু?

সঞ্জয়বাবুর ব্যবসার প্রাক্তন ম্যানেজার রমেশকুমার ঝা জানান, তাঁরা বাজার থেকে দামি গাড়ি ভাড়া নিয়ে সেগুলিকে আবার সারদা সংস্থাকে ভাড়া দিতেন। বিল বাবদ সারদার কাছ থেকে যে টাকা মিলত, তার একাংশ দিতেন গাড়ির মালিককে। বাকিটা ছিল লাভ। রমেশবাবু জানান, ২০১১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সারদা সংস্থা থেকে বকেয়া টাকার বেশ খনিকটা মিলেছিল। তার পরে বকেয়া বাড়তে থাকে। সঞ্জয়বাবু একাধিক বার সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে দেখা করে বকেয়া মেটানোর অনুরোধ করেছিলেন। রমেশবাবুর দাবি, বকেয়া বাড়ছে জেনেও সারদা কর্তা কিন্তু গাড়ি ভাড়া নেওয়া বন্ধ করেননি। পাকাপাকি বন্ধ হওয়ার কয়েক দিন আগে সঞ্জয়বাবুর কাছ থেকে গাড়ি নেওয়া বন্ধ করে দেয় সারদা। তত দিনে সারদার কাছে তাঁদের পাওনা হয়েছে আধ কোটি টাকারও বেশি।

সঞ্জয়বাবুর পরিবারের পক্ষ থেকে ওই সব বিলের যাবতীয় নথি শ্যামল সেন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে কমিশন বিশেষ আশার কথা শোনাতে পারেনি। কমিশনের পক্ষ থেকে সঞ্জয়বাবুর পরিবারকে বলা হয়েছে, সারদার সম্পত্তি বিক্রি করে প্রথমে আমানতকারীদের টাকা দেওয়া হবে। তার পরে তাঁদের বকেয়ার ব্যাপারে ভেবে দেখবে কমিশন।

রমেশবাবু জানান, সঞ্জয়বাবুরা আদতে বিহারের মধুবনির বাসিন্দা। সেখানে তাঁদের সামান্য জমিজমা ছিল। তা বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া গিয়েছে, তার বেশির ভাগ গিয়েছে পাওনাদারদের টাকা মেটাতে। তার পরে বেহালার বাড়ি বন্ধক রেখে ২০ লক্ষ টাকার ব্যাঙ্ক ঋণের আবেদন করেছিলেন সঞ্জয়বাবু। কিন্তু ঋণ পাওয়ার আগেই তাঁর সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়।

পরমাদেবী জানান, তাঁর স্বামীর নিজস্ব চারটি গাড়ি ছিল। সেগুলি বিক্রি করেও পাওনাদারদের কিছু টাকা মেটানো হয়েছে। আরও অনেক মেটানো বাকি। তার উপরে স্বামীর চিকিৎসা ও সংসার চালানোর খরচ। কী যে হবে, বুঝতে পারছেন না পরমাদেবী। তিনি বলেন, “শুনেছি রাজ্য সরকার সারদার আমানতকারীদের টাকা কিছু ফেরত দিয়েছে। যদি আমার স্বামীর চিকিৎসা খরচের কিছুটাও সরকার দিত, তা হলে সামান্য স্বস্তি পেতাম।”

মানসিক ভাবে ভেঙেই পড়েছেন পরমাদেবী। তবু গত চার মাস ধরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাসপাতালেই থাকছেন, জানালেন সঞ্জয়বাবুর এক প্রাক্তন কর্মী। অনেক দিন ঠিকমতো খাবারও জুটছে না তাঁদের। প্রতিদিনই চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে পরমাদেবী জিজ্ঞেস করছেন, স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবেন কি না। এক চিকিৎসক বললেন, “ওঁর অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু কী বলব বলুন তো!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shubhashis ghatak saradha case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE