মৃত দীপু শর্মা। ছবি: প্রকাশ পাল।
একচিলতে গলিটায় সকাল থেকে থিকথিকে ভিড়।
আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই ভিড়টা অপেক্ষায় আছে। শর্মা পরিবারের জলজ্যান্ত ছেলেটা দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরল না। অন্তত শেষ দেখাটুকু যদি দেখা যায়...।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ট্রেনের মহিলা কামরা থেকে পড়ে গিয়েছিল দীপক শর্মা ওরফে পাড়ার দিপু। অনেকেরই দাবি, এক মহিলা আরপিএফ জওয়ান তাঁকে চলন্ত ট্রেন থেকে ঠেলে দেন।
কিন্তু কেন?
এই একটি প্রশ্নই বুধবার দিনভর ঘুরেছে হুগলির উত্তরপাড়ার দ্বারিক জঙ্গল রোডে ওই ভাড়াবাড়ি ঘিরে। ছট পুজো থাকায় রোজকার মতো তিনি টিকিয়াপাড়ায় অফিস করতে যাননি। মা অন্নপূর্ণা বড়বাজার থেকে পুজোর কিছু উপকরণ আনতে বলেছিলেন। সে সব কিনেই সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশন থেকে মাতৃভূমি লোকাল ধরেছিলেন দিপু। তার পরে বিশ মিনিটের মধ্যে যা ঘটে গিয়েছে, বাড়ির কেউ আর সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি। রাতটা হাওড়ায় লাশকাটা ঘরেই কাটিয়েছে দিপুর নিথর দেহ।
পড়ুন: কী ‘ইনটেনশন’ তোর, বলেই ধাক্কা মারল মহিলা কনস্টেবল
ঘটনাচক্রে, যুবকের অপমৃত্যু নিয়ে হিন্দমোটর স্টেশনে গোলমালে যখন ট্রেন বন্ধ, বেলুড়ে আরও অনেকের সঙ্গে আটকে পড়েছিলেন তাঁর বাবা মদনলাল শর্মাও। শুধু জানতেন না, ছেলেটা তাঁরই। এ দিন বাড়ির ছোট দাওয়ায় তক্তপোষে বসে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘মহিলাদের কামরায় ওঠা নিশ্চয়ই বেআইনি। কিন্তু ট্রেনে ভিড় ছিল। দিপু নেমে অন্য কামরায় যেতে গিয়ে দেখে, সেটা মেয়েদের। ট্রেন ছুটতে শুরু করায় ও বাধ্য হয়ে উঠে পড়েছিল। শুনেছি, তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছিল। মহিলা আরপিএফ চাইলে ওকে ধরে রেলপুলিশের হাতে দিতে পারতেন। কিন্তু ও ভাবে...’’ —বলতে-বলতে কান্নায় বুজে আসে সত্তর পার করা বৃদ্ধের গলা।
চারপাশে তখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে পাড়াপড়শি। হাজির উত্তরপাড়ার পুরপ্রধান দিলীপ যাদবও। অন্য ঘরে তখন পাড়ার মহিলারা অন্নপূর্ণা এবং দিপুর স্ত্রী সুষমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন তাঁরা। প্রতিবেশী প্রতিমা দাস ফুঁসে ওঠেন, ‘‘মেয়েরা তো শুনি মায়ের জাত। কী করে একটা মায়ের কোল খালি করে দিতে পারলেন ওই মহিলা জওয়ান? ওঁর শাস্তি চাই।’’
পড়ুন: কনস্টেবলের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু
প্রায় ছ’বছর হল এ পাড়ায় ভাড়া আছেন শর্মারা। দিপু বাড়ির একমাত্র ছেলে, দুই দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাড়িওয়ালা বাবু দাস বলেন, ‘‘দিপু খুব ভাল ছেলে। একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করত। বাবা আর ছেলে দু’জনের আয়ে চলত ওদের। নইলে সত্তর পার করা বাবাকে রোজ কাজে বেরোতে হয়? ছেলে তো গেলই, গভীর সঙ্কটে পড়ে গেলেন ওঁরা।’’
একটানা কেঁদে চলেছিলেন সুষমা। বহুক্ষণ কথাই বলতে পারছিলেন না। শেষে নিচু গলায় বলেন, ‘‘এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল! কী করে সামাল দেব। আমি কিছু লেখাপড়া শিখেছি। কিন্তু কে দেবে কাজ, আমি তো...’’
ফের কথা ডুবে যায় কান্নায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy