Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সারদার দু’টি টিভি চ্যানেলই চালু, কী ভাবে, তদন্ত

তদন্তের নজর এ বার ‘দূর দর্শন’-এ। সারদা অর্থলগ্নি সংস্থা লাটে উঠেছে। জেলে গিয়েছেন সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে সিবিআই, ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা। কিন্তু সারদার বিপুল অথর্র্ নয়ছয় করে যে দু’টি খবরের চ্যানেল সুদীপ্ত সেন কিনেছিলেন, সে দু’টি চ্যানেলের সম্প্রচার এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। চ্যানেল টেন ও তারা নিউজ। প্রথমটি বেশ কিছু দিন চালিয়েছেন শাসক দলেরই এক নেতা। দ্বিতীয়টি এক রকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৪ ০২:৫২
Share: Save:

তদন্তের নজর এ বার ‘দূর দর্শন’-এ।

সারদা অর্থলগ্নি সংস্থা লাটে উঠেছে। জেলে গিয়েছেন সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে সিবিআই, ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা। কিন্তু সারদার বিপুল অথর্র্ নয়ছয় করে যে দু’টি খবরের চ্যানেল সুদীপ্ত সেন কিনেছিলেন, সে দু’টি চ্যানেলের সম্প্রচার এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। চ্যানেল টেন ও তারা নিউজ। প্রথমটি বেশ কিছু দিন চালিয়েছেন শাসক দলেরই এক নেতা। দ্বিতীয়টি এক রকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে।

সুদীপ্ত সেন কেন ওই দু’টি নিউজ চ্যানেল কিনেছিলেন, এই ব্যাপারে কেউ তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন বা তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন কি না সিবিআই, ইডি তা খতিয়ে দেখছে। চ্যানেল দু’টির কর্ণধার অর্থাৎ সুদীপ্ত গ্রেফতার হওয়ার পরে কী ভাবে সেগুলির মালিকানা বদল হল এবং কে-ই বা সে দু’টি চালানোর অর্থ জোগাড় করল, এ বার সেই তথ্য জানতে তৎপর হয়েছে সিবিআই।

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভামঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর সাংবাদিকদের মুখ চেয়ে চ্যানেল টেন চালাতেন সমীর (বুয়া) চক্রবর্তী। সমীরবাবু বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তীর স্বামী। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছিলেন, “চ্যানেল টেন বুয়া চালাত। এখন বন্ধ।” ঘটনা হল, ধুঁকতে ধুঁকতে চললেও চ্যানেল টেন কিন্তু এখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, কয়েক ঘণ্টা করে হলেও অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে। তবে শুক্রবার আচমকা চ্যানেল টেন-এর অফিসের বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেন বাড়ির মালিক। সন্ধেয় ওই চ্যানেলের কর্মীদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ‘পোস্ট ডেটেড চেক’ দেওয়া হলে বিদ্যুৎসংযোগ ফের চালু হয়।

তারা চ্যানেলের জন্য যে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হতো, সে কথাও দলের ছাত্র সংগঠনের সভায় জানিয়েছেন মমতা। শুধু তা-ই নয়, তারা চ্যানেল চালানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মুখ্যমন্ত্রী তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরকে নির্দেশ দেন। প্রসঙ্গত, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর মুখ্যমন্ত্রীর হাতে।

সুদীপ্ত সেন চ্যানেল টেন ও তারা নিউজ কিনে নেওয়ার অব্যবহিত পরেই ওই দু’টি খবরের চ্যানেল যে কার্যত তৃণমূলের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছিল, সেই অভিযোগ বহু বিরোধী নেতা বার বার তুলেছেন। সে জন্যই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি খতিয়ে দেখছে, ওই দু’টি চ্যানেল কেনার জন্য সুদীপ্তকে প্রভাবিত করার পিছনে তৃণমূলের কোনও নেতা বা তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ কারও ভূমিকা ছিল কি না। সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসা ও সুদীপ্ত সেন ধরা পড়ার পর চ্যানেল দু’টি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে তৃণমূল, এমনকী খোদ রাজ্য সরকার কেন সেগুলিকে ফের চালু করতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল, সে সবও অনুসন্ধান করেন তদন্তকারীরা।

মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূল নেতারা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সেখানকার সাংবাদিকদের সমস্যার কথা তোলায় সেই প্রসঙ্গ টেনেই তদন্তকারীদের একাংশের প্রশ্ন, সারদার প্রথম নিজস্ব মিডিয়া ভেঞ্চার একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক হলেও সেই প্রকাশনাগুলি পুনরুজ্জীবনের কোনও উদ্যোগ তবে দেখা গেল না কেন? কেন শুধু ওই দু’টি চ্যানেলকে যে কোনও ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে উদ্যোগী হল সরকার তথা শাসক দল? সেই সঙ্গে চ্যানেল টেন থেকে কিছু দামী বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম উধাও হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তারও খোঁজ নিচ্ছেন তদন্তকারীরা।

শান্তনু ঘোষ নামে এক ব্যবসায়ী ২০০৮ সালে চ্যানেল টেন শুরু করেছিলেন। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে ইডি তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। সিবিআই-ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে শান্তনুু ওই চ্যানেল চালাতে না পেরে বন্ধ করে দেন। সিবিআই-কে লেখা চিঠিতে সুদীপ্ত সেন জানান, শান্তনু ঘোষের কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকায় চ্যানেল টেন কিনে নেন তিনি। সেটা ২০১০-এর গোড়ার দিক। পরে সেই চ্যানেলের পিছনে আরও কয়েক কোটি টাকা ঢেলেছিলেন বলে জানান সুদীপ্তবাবু। সারদার হাতে আসার পর চ্যানেল টেনের অফিস পার্ক স্ট্রিট থেকে সরে যায় রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডে। এর বছর তিনেকের মাথায় সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসায় রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে সুদীপ্ত সেন ঘোষণা করেন, তাঁর পক্ষে আর ওই চ্যানেল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তদন্তকারীরা জেনেছেন, তার তিন-চার মাস আগে থেকেই বেতন সংক্রান্ত গণ্ডগোল শুরু হয় সেখানে।

২০১৩-র জুলাই মাসে চ্যানেল টেন চালানোর জন্য কর্মীরা একটি অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেন। সে বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই অ্যাসোসিয়েশন-ই চ্যানেল টেন চালায়। তদন্তকারীরা জেনেছেন, সেই সময়ে প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে মাসে মাসে ১০ টাকা করে তুলে একটি তহবিলও গড়া হয়। তখন ওই চ্যানেলের কর্মী ছিলেন ১৮০ জন। ওই বছর অক্টোবর মাসে সমীর চক্রবর্তী ওরফে বুয়া অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন এবং কর্মীদের নতুন বেতন-কাঠামো তৈরি করা হয়। সেই মতো এক ধাক্কায় কিছুটা কমে যায় কর্মীদের অনেকের বেতন। তবে তার পরেও কর্মীদের প্রত্যেকের থেকে প্রতি মাসে ১০ টাকা চাঁদা তুলে তহবিলে দেওয়ার বিষয়টি চালু ছিল।

এই ভাবে কয়েক মাস চলার পর, ২০১৪-র মে মাসে বুয়া চক্রবর্তী জানিয়ে দেন, তিনি আর চ্যানেল টেন চালাতে পারবেন না। নিজের টাকা অ্যাসোসিয়েশনের কাছে ফেরত চান তিনি। তখনই কর্মীরা জানতে পারেন, বুয়া চক্রবর্তী কোনও লগ্নি করেননি, তিনি কেবল টাকা ধার দিয়েছিলেন চ্যানেল চালাতে। আরও জানা যায়, অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গে হওয়া চুক্তিতে তিনি জানিয়েছিলেন, পরে চ্যানেল দাঁড়িয়ে গেলে বা অন্য কেউ চ্যানেল চালানোর দায়িত্ব নিলে তাঁকে তাঁর টাকা সুদ সমেত ফেরত দিতে হবে। বুয়া ওই সময়ে জানান, ২০১৩-র অক্টোবর থেকে ২০১৪-র মে পর্যন্ত চ্যানেল টেন চালাতে ১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছেন তিনি। কিন্তু বুয়া আদৌ টাকা ফেরত পেয়েছিলেন কি না কিংবা পেলে কতটা, কী ভাবে পেয়েছেন, সেটা তদন্তকারীরা খোঁজ নিয়ে দেখছেন।

তদন্তে জানা গিয়েছে, চ্যানেল টেন-এর কর্মীদের মে মাসের বেতন মেটানো হয় বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে। তবে জুন মাসে কর্মীদের প্রত্যেকে তিন হাজার টাকা এবং জুলাই মাসে এক হাজার টাকা পান। এই অবস্থায় এ মাসে তৈরি হওয়া কর্মীদের নতুন একটি অ্যাসোসিয়েশন বিজ্ঞাপনের টাকা দিয়ে কোনও মতে চ্যানেল চালু রেখেছে। তবে গত সপ্তাহে কর্মীদের একাংশের মধ্যে গণ্ডগোলের জেরে চ্যানেল কয়েক ঘণ্টার জন্য ‘অফ এয়ার’ ছিল।

সেখানে তারা চ্যানেলের অবস্থা কী?

শ্যামল সেন কমিশনের কাছে সুদীপ্ত সেন জানিয়েছিলেন, তিনি ৮৬ কোটি টাকায় ব্রডকাস্ট ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সংস্থার অধীনে থাকা তারা নিউজ, তারা মিউজিক, তারা পঞ্জাবি এবং টিভি সাউথ এশিয়া এই চারটি চ্যানেল কিনেছেন। গত জানুয়ারিতে কমিশনকে সুদীপ্ত জানান, ওই সব ক’টি চ্যানেল তিনি বিক্রি করে দিতে চান। এবং ওই বাবদ যে টাকা পাওয়া যাবে, তা আমানতকারীদের ফেরত দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

তদন্তকারীরা জেনেছেন, টিভি সাউথ এশিয়া আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা পঞ্জাবি সে ভাবে চালু হয়নি। সারদা কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরে তারা নিউজ ও তারা মিউজিক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে কর্মীরাই ‘এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরকে নির্দেশ দেন। এর পরই সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওই দু’টি চ্যানেল চালানোর কাজ চলে। কর্মীদের নিয়মিত বেতনেরও ব্যবস্থা করা হয়। ঠিক হয়, প্রত্যেক কর্মীকে মাসিক ১৬ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হবে।

এখনও পর্যন্ত সে ভাবেই চলছে তারা। যদিও শ্যামল সেন কমিশনের কাছে সুদীপ্ত জানিয়েছেন, তাঁকে না জানিয়েই ওই চ্যানেল চালানো হচ্ছে। কমিশন ওই চ্যানেল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেও তা কার্যকর হয়নি। সারদার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করার কথা উঠতেই চ্যানেলের কর্মীদের অ্যাসোসিয়েশন শ্যামল সেন কমিশনের দ্বারস্থ হয়। কমিশনের কাছে লিখিত আবেদন করে জানানো হয়, ওই সম্পত্তি বিক্রি হওয়ার আগে যেন তাঁদের চ্যানেল বন্ধ না করা হয়।

তদন্তকারীরা জেনেছেন, চ্যানেল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে আদালতের মাধ্যমে কর্মীরাই সংগঠন গড়ে চ্যানেল চালাতে শুরু করেন। রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, বিশেষ ত্রাণ তহবিল গড়ে চ্যানেল চালানোয় সাহায্য করা হবে। এখনও সেই ত্রাণের টাকাতেই চ্যানেল চলছে, নাকি অন্য কেউ টাকা দিচ্ছেন, সিবিআই তা খতিয়ে দেখছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam cbi channel 10 tara music
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE