Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শুধু চামড়াটাই তো পুড়েছে, হাসছেন মনীষা

সকালে ঘুম ভেঙে আয়নায় নিজের মুখটা চোখে পড়ে। বীভৎস পোড়া একটা মুখ। গলা-বুক-হাতের চামড়াগুলো গুটিয়ে যাওয়া। বাঁ চোখের জায়গায় একটা ঝাপসা গর্ত। এক মগ নাইট্রিক অ্যাসিডের ঝাঁঝ পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু।

মনীষা। তখন ও এখন। এখনকার ছবিটি তুলেছেন সন্দীপ সাহা।

মনীষা। তখন ও এখন। এখনকার ছবিটি তুলেছেন সন্দীপ সাহা।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৬ ০৪:২৫
Share: Save:

সকালে ঘুম ভেঙে আয়নায় নিজের মুখটা চোখে পড়ে।

বীভৎস পোড়া একটা মুখ। গলা-বুক-হাতের চামড়াগুলো গুটিয়ে যাওয়া। বাঁ চোখের জায়গায় একটা ঝাপসা গর্ত। এক মগ নাইট্রিক অ্যাসিডের ঝাঁঝ পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু।

ছোটবেলা থেকে একটাই চিন্তা ছিল ডানপিটে মেয়ের। পড়াশোনা করে একটা ভাল চাকরি। সব্জিওলা বাবার মুখে হাসি, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, দিন-রাত এক করে ঘরের কাজ করে যাওয়া মায়ের একটু আরাম। পড়াশোনার পাশাপাশি তাই নার্সিং ট্রেনিং, কম্পিউটার কোর্স, বিউটিশিয়ান কোর্স, হাতের কাজেও তুখোড় হয়ে ওঠার লড়াই চলছিল জয়নগরের মনীষার। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে তখনও ভাবতে পারেননি, এর চেয়েও বড় লড়াই অপেক্ষা করছে হাসপাতাল-থানা-আদালতে। কে-ই বা ভাবতে পারেন, পাড়ায় ছোট থেকে দেখা কয়েকটা মানুষ এক শীত-সন্ধেয় স্রেফ ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অ্যাসিড ছুড়ে যাবে মুখে!

আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় কত কথা!

সুন্দরী, স্বাধীনচেতা, তড়বড় করে কথা বলা এক মেয়ে। আগেও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত অনেকে। এখনও দেখে— কারণটা শুধু বদলে গিয়েছে। অ্যাসিডের ঘটনার পর একটা মামলা হয়েছিল। যে মামলায় মঙ্গলবারই হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, মনীষাকে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য। জামিন পাওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে পাঁচ জনকে ফের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও মূল অভিযুক্ত সেলিম
এখনও পলাতক।

‘ক্ষোভ’, ‘সুবিচার’, ক্ষতিপূরণ’, ‘নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন’— বাঁধাধরা শব্দগুলোর দিকে গল্পটার ঘুরে যাওয়ার কথা ছিল এর পরেই। সচরাচর তা-ই হয়। কিন্তু মনীষার কথা শুনলে ধাক্কা লাগে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে তিনি বলছেন, ‘‘একটু চামড়াই তো পুড়েছে আমার। সে জন্য বেঁচে থাকার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে? একটা ভাল চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে কি ঝকঝকে চামড়াই একমাত্র যোগ্যতা?’’

তেইশ বছরের মেয়ে বলেই চলেছেন, ‘‘নিজের যোগ্যতায় একটা চাকরি পেয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই ওই তিন লাখ টাকা রোজগার করে ফেলতে পারি আমি। পারবও। কিন্তু যে যন্ত্রণার পথ পার করতে হল, সেই ক্ষতির তো কোনও পূরণ হয় না।’’ তখনই শুধু মনে হয়, পোড়ার দাগ মিলিয়ে না যাক, চোখটা যদি অন্তত সেরে যেত! বললেন, চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে ২১ দিন ভুল চিকিৎসা না হলে হয়তো বেঁচেও যেত চোখটা। এসএসকেএমে এখনও চিকিৎসা চলছে তাঁর।

বাকিটা কিন্তু আগের মতোই আছে। একটু চামড়া পুড়ে যাওয়া বই তো নয়!

আত্মবিশ্বাস, মানসিক কাঠিন্য কোন পর্যায়ে পৌঁছলে নিজেকে এতটাও বুঝিয়ে ফেলতে পারেন কেউ! অথচ জীবনের ঠাট্টা এমনই, বাইরের দুনিয়ায় এখনও তাঁকে নিয়ে গুজগুজ-ফুসফুস। সেই অভিশপ্ত সন্ধের পর থেকেই মনীষা বুঝতে শুরু করেছিলেন, অ্যাসিডে শুধু মুখ পোড়েনি, তাঁর চরিত্রটাকেও পুড়িয়ে দিয়েছে সমাজের একটা অংশ।

হাসপাতালের বিছানায় তখন শুয়ে মনীষা। চোখ-মুখ জড়িয়ে ব্যান্ডেজ। কানে ঢুকছিল, তাঁর বেডের পাশে দাঁড়িয়েই কারা বলছে, ‘‘ভাল ঘরের মেয়েদের তো এমন হয় না!’’ এরা নাকি হাসপাতালে ‘দেখতে’ এসেছিল তাঁকে! এই সে দিনও ট্রেনে গোটা কাহিনি শুনে এক সহযাত্রী প্রশ্ন করেছেন— ‘‘শুধু অ্যাসিড? রেপ করেনি?’’ সমাজকর্মী ও নারী আন্দোলনে সামিল সুপর্ণা পালের নাগেরবাজারের বাড়িতে বসে ঘটনাটা বলতে বলতে আবার হেসে ফেলছিলেন মনীষা। যেন ভারী আমোদ পেয়েছেন।

অতীতের আয়নায় ফিরে ফিরে আসে দিনগুলো।

মনীষা বলে চলেন, ‘‘কোনও দিন স্বপ্নের রাজপুত্রের কল্পনায় নিজেকে ভাসাইনি। একটাই স্বপ্ন ছিল, বড় চাকরি করব। টিভি দেখে দেখে ইংরেজি আর হিন্দি বলতাম। নাচের স্টেপ তুলতাম। ‘স্মার্ট’ হওয়ার চেষ্টা করতাম।’’ ফিসফাস তাই আশপাশে চলতই। মেয়েটার এত বাড় বেড়েছে কেন? ঘর-সংসারের কাজ না শিখে সারা দিন টো টো করে এই কোর্স, সেই কোর্স। তার ওপর আবার বিএ পাশ! মনীষা আজ বোঝেন, যারা তাঁকে অ্যাসিড মেরেছিল আর যারা হাসপাতালে দাঁড়িয়ে তাঁর চরিত্র-চর্চা করেছিল— তাদের গা-জ্বালার জায়গাটায় খুব একটা ফারাক হয়তো নেই।

ইদে বাড়ি গিয়ে দেখেছিলেন, বুক ফুলিয়ে ঘুরছে জামিনে মুক্ত অভিযুক্তরা। তখনই আরও এক বার দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়েছিল সঙ্কল্প। ‘ওদের’ সামনে গিয়েই হাসিমুখে দাঁড়াতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, কিছুই পোড়াতে পারেনি তোমাদের অ্যাসিড। পোড়াতে পারেনি আমার ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়াগুলো। আজও জোরে গান চালিয়ে নাচেন মনীষা। আজও ইদের দিনে তাঁর কাছে সাজতে আসেন পাড়ার মেয়ে-বৌরা। বিউটিশিয়ান কোর্সের ভাল ছাত্রী ছিলেন তিনি।

তবে এমনও অনেকে আছে, যারা তাঁর সঙ্গে সহজ হতে পারেনি আর। মনীষার সত্যিকারের কষ্ট হয়, যখন বাচ্চারা তাঁকে দেখে ভয় পায়। তখনই চোখের কোণটা একটু ভিজে ওঠে। কিন্তু ওঁর গল্প শুনে আনকোরা কেউ কেঁদে ফেললে মণীষাই তাঁকে মনে করিয়ে দেন, ‘‘এটা কোনও দুঃখী মেয়ের কথা নয়। সবাই নিজের লড়াই করে বাঁচে, আমিও বাঁচছি। খুশিতে বাঁচছি।’’

কিন্তু সমাজের বাঁকা দৃষ্টিটা? তার থেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে না নিজেকে? উত্তর আসে— ‘‘আমার এই পুড়ে যাওয়া মুখটাই আসলে সমাজের আয়না। এই মুখেই লুকিয়ে আছে আমার মতো অসংখ্য মেয়ের লড়াই।’’

নিভে আসা বিকেলের রোদ্দুর তখন ঝিকমিক করছে মনীষার চোখেমুখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Acid attack Manisha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE