Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
ঘায়ের চোটে শরীর অসাড়

অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়ায় আটকে ছোট্ট সৃজলের চিকিৎসা

কুঁচকি ও পিঠের ঘায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কোমর থেকে শরীরের নীচের অনেকটা অংশই অসাড়। মলমূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ জানিয়ে দিয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি দরকার।

আট বছরের সৃজল রাই। —নিজস্ব চিত্র।

আট বছরের সৃজল রাই। —নিজস্ব চিত্র।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:০৩
Share: Save:

কুঁচকি ও পিঠের ঘায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কোমর থেকে শরীরের নীচের অনেকটা অংশই অসাড়। মলমূত্র ত্যাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ জানিয়ে দিয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারি দরকার। তাদের সেই চিকিৎসার পরিকাঠামো নেই বলে তারা ‘রেফার’ করে দিয়েছে কলকাতার এসএসকেএমে। কিন্তু স্যালাইন, অক্সিজেন সমেত অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে আট বছরের ছেলে সৃজলকে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার টাকা বাবা রমেশ রাইয়ের নেই। যেখানে খরচ পড়বে বেশ কয়েক হাজার টাকা, পেশায় প্রান্তিক চাষি রমেশের পকেটে সেখানে পড়ে আছে মাত্র শ’তিনেক।

হাসপাতালে ছেলের বিছানার ধারে বসে তাই কেঁদেই চলেছেন কালিম্পঙের পেডংয়ের কাগজি বস্তির ওই বাসিন্দা।

এ রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে যাবতীয় চিকিৎসা, এমনকী পরীক্ষানিরীক্ষাও ফ্রি। তা হলে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে কোনও গরিব রোগীকে রেফার করা হলে সেখানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল নেবে না, সৃজলের ঘটনায় সামনে এসেছে সেই প্রশ্নও।

শুক্রবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগে দাঁড়িয়ে রমেশ বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা বলেছেন, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে না পারলে ছেলেটাকে বাঁচানো মুশকিল। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তাই সকলের কাছে হাতজোড় করছি।’’

যাদের উদ্যোগে শিশুটিকে কালিম্পং থেকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়েছে, সেই ‘চাইল্ডলাইন’ সংস্থার শিলিগুড়ির কো-অর্ডিনেটর সোনুবাহাদুর ছেত্রী বলেন, ‘‘এমন অবস্থায় বাচ্চাটিকে তো ট্রেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাতে ওর নিজের তো বটেই, এমন কী সহযাত্রীদেরও খুবই সমস্যা হবে। সরকারি সাহায্য মিললে ভাল হতো।’’

জেলা শিশু কল্যাণ কমিটির পক্ষ থেকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে অ্যাম্বুল্যান্সের টাকা দেওয়ার জন্য সরকারি ভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। এ দিনই কমিটি লিখিত ভাবে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা দার্জিলিঙের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, ঘটনাটি তাঁর নজরেও এসেছে। যদিও রাত পর্যন্ত অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যাপারে তাঁদের কাছ থেকে কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি মেলেনি।

এ ব্যাপারে কি কিছুই করতে পারে না স্বাস্থ্য দফতর? রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই ধরনের খরচের জন্য আলাদা কোনও খাত নেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল চাইলে রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য টাকা দিতেই পারে। বরং আমি বলব, মানবিক কারণে সেটা দেওয়াই উচিত।’’ এ নিয়ে দফতরের শীর্ষ স্তর থেকে কোনও প্রশ্ন উঠবে না বলেই অভিমত তাঁর।

রমেশ জানিয়েছেন, সৃজলকে মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে সন্তানের চার মাস বয়সে। একাই ছেলেকে বড় করেছেন তিনি। তিন বছর বয়সে সৃজলের কুঁচকিতে ফোড়া হয়। পরে পিঠের নীচের দিকেও আর একটি ফোড়া হয়। ধীরে ধীরে তা থেকে ঘা হতে শুরু করে। স্থানীয় চিকিৎসক সারাতে পারেননি। ক্রমে বিষয়টি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মাস কয়েক আগে হঠাৎ তার কোমরের নীচ থেকে অসাড় হতে শুরু করে। গত ৫ ডিসেম্বর ‘চাইল্ডলাইন’-এর দুই সদস্য কুমার থাপা ও সুবর্ণা খবর পেয়ে শিশুটিকে কালিম্পং হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখান থেকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে পাঠানো হয়।

সৃজলকে এসএসকেএমে ‘রেফার’ করেছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল। কলকাতার সেই হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক অরিন্দম সরকারের অনুমান, শিশুটির হয়তো সেলুলাইটিস হয়েছিল। তা থেকে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু নীচের অংশ অসাড় কেন হল, তা পরীক্ষানিরীক্ষা না করে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘‘নিউরো সার্জারির চিকিৎসকেরা সে বিষয়ে জানাতে পারবেন।’’

কলকাতায় পৌঁছলে প্লাস্টিক সার্জারি, নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক মিলিয়ে দীর্ঘ চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে সৃজলকে। কোনও মতে ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গেলেও বাকিটা সামালানো যে সহজ নয়, রমেশ তা বোঝেন। আপাতত উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ছেলের সঙ্গেই থাকেন, ছেলেকে দেওয়া খাবারই ভাগ করে খান তিনি। ‘‘কলকাতার বড় হাসপাতালে যদি সেটা না-ও হয়, ফুটপাথে পড়ে থাকব। সব কষ্ট সহ্য করতে রাজি আছি, শুধু যে কোনও মূল্যে ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে,’’ কাঁদতে কাঁদতে গলা বুজে আসে রমেশের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Srijal Rai Ambulance Rent
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE