Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আনন্দবাজারের অন্তর্তদন্ত

হারানো জমি ফিরে পেতেই মাঠে আরাবুল

গাছের গুঁড়িতে টাঙানো পুলিশের ছেঁড়া উর্দি। বড় বড় পুলিশের গাড়ি এখনও মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে পুকুরে। রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে কাঁদানে গ্যাসের তাজা শেল। উদ্ধার করার কেউ নেই। কয়েক ফুট অন্তর গুঁড়ি ফেলে আটকানো হয়েছে রাস্তা।

শুভাশিস ঘটক
ভাঙড় শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৮
Share: Save:

গাছের গুঁড়িতে টাঙানো পুলিশের ছেঁড়া উর্দি।

বড় বড় পুলিশের গাড়ি এখনও মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে পুকুরে।

রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে কাঁদানে গ্যাসের তাজা শেল। উদ্ধার করার কেউ নেই। কয়েক ফুট অন্তর গুঁড়ি ফেলে আটকানো হয়েছে রাস্তা।

তাণ্ডবের ২৪ ঘণ্টা পরে, বুধবারের ভাঙড় যেন পুরোপুরি এক মুক্তাঞ্চল! যেখানে পোস্টার পড়েছে, ‘পুলিশ নয়। শান্তি চাই’। যেখানে এক আন্দোলনকারী সরাসরিই বলছেন, ‘‘আমরা পুলিশকে সরিয়ে দিয়েছি। পুলিশকে ঢুকতে দেব না।’’

যে ‘পাওয়ার গ্রিড’কে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার ভাঙড়ে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি হয়, দু’জনের প্রাণহানি হয়, তার জমি কেনা হয়ে গিয়েছিল বছর চারেক আগে। ইতিমধ্যেই গ্রিডের সাব-স্টেশন তৈরি হয়ে গিয়েছে, ৯৫% কাজও শেষ। তবু, কেন এতদিন পরে জমি নিয়ে এত গেল গেল রব উঠল দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই এলাকায়?

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মঙ্গলবার রাতে ভাঙড়ে গিয়েছিলেন বিধায়ক তথা মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা। দক্ষিণ গাজিপুরে দলীয় কার্যালয়ে তিনি যখন পৌঁছন, তাঁর মোবাইলে এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার ফোন আসে। এ প্রান্ত থেকে রেজ্জাককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি তো প্রথম থেকেই বলছি মুখ্যমন্ত্রীকে বলুন, পুলিশ দিয়ে নকশালগুলোকে সরিয়ে দিতে। আর আপনি এখানকার তৃণমূল নেতাদের সামলান। তা হলে সমস্যা মিটে যাবে’। কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন রেজ্জাক? এক রেজ্জাক-ঘনিষ্ঠের দাবি, ‘‘ফোনের ও প্রান্তে ছিলেন দলের জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়।’’ শোভনবাবু অবশ্য এ কথা মানেননি।

শোভনবাবু না মানলেও রেজ্জাকের এই ফোন থেকেই পরিষ্কার, এই আন্দোলনের কুশীলব কারা। গোয়েন্দা সূত্র, শাসকদলের নেতাদের একটা বড় অংশ ও সাধারণ মানুষের কথা থেকে যা জানা যাচ্ছে, তার মূল নির্যাস— অনেক রকম স্বার্থের টানাপড়েন। যেখানে আরাবুল ইসলাম আছেন, শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রয়েছে, নকশালদের একাংশ রয়েছে, প্রোমোটার-চক্র রয়েছে এবং রয়েছে এই প্রকল্পে কাজ না-পাওয়া স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ।

কলকাতার উপকণ্ঠে উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া, রাজারহাট, নিউ টাউন ঘেঁষা দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই এলাকার বাসিন্দাদের চাষাবাদই মূল জীবিকা। বাসিন্দারা মূলত সংখ্যালঘু। এখানে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গিয়েছে সাধারণ মানুষের। ফলে, বছর দেড়েক আগে টোনা মৌজায় নির্মীয়মাণ ‘পাওয়ার গ্রিড’-এর সাব-স্টেশনের মাটি ফেলার বরাত নিয়ে আরাবুলের সিন্ডিকেটের সঙ্গে আর এক তৃণমূল নেতা নান্নু হোসেনের সিন্ডিকেটের রেষারেষিতে নতুন কিছু খুঁজে পাননি স্থানীয়েরা। তবে, তার মধ্যেই যে মঙ্গলবারের অশান্তির বীজ রয়ে গিয়েছিল, এখন মানছেন অনেকে।

তৃণমূল নেতাদেরই একাংশ জানিয়েছেন, গ্রিডের ১৩ একর নিচু জমিতে মাটি ফেলার বরাত পেয়েছিল আরাবুলের সিন্ডিকেট। তা মানতে পারেননি নান্নু হোসেন। কারণ, এর মধ্যে ছিল কোটি টাকার মুনাফার সুযোগ। ফলে, বিবাদ আটকানো যায়নি। তার মধ্যেই আরাবুলের হাত ধরে ২০০৮ সালে তিনটি প্রোমোটার সংস্থা ওই মৌজাতেই গ্রিড ঘিরে থাকা কয়েক হাজার বিঘা চাষজমি জোর করে কিনে নিয়েছিল। গ্রিডের টাওয়ার ওই সব জমিতেই পোঁতা হয়েছে। টাওয়ার হওয়ায় ওখানে বহুতল আবাসন প্রকল্প করা যাচ্ছে না। তাই লোকসানের আশঙ্কায় ওই প্রোমোটাররা ফের আরাবুলেরই শরণাপন্ন হন। যে কোনও ভাবে যাতে পাওয়ার গ্রিডের প্রকল্পটি বাতিল হয়, সেই পরিকল্পনাই ছিল তাদের। একই সঙ্গে আরাবুল-বিরোধী নান্নুকে হাতে রাখতে আবাসন প্রকল্পের জমিতে মাটি ফেলার বরাত দেওয়া হয়েছিল।

এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু বিধানসভা ভোটের পর রেজ্জাক মোল্লা ভাঙড়ের বিধায়ক হওয়ায় আরাবুলের পায়ের তলার মাটি সরতে থাকে। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে ও রেজ্জাককে অস্বস্তিতে ফেলতে আরাবুল পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে মাত্রা বাড়াতে থাকেন বলে দাবি করেছেন অনেক নেতাই। একই দাবি গোয়েন্দাদেরও। গ্রিড হলে বাসিন্দাদের নানা শারীরিক সমস্যা হবে বলে আরাবুলের ছেলেরা রটাতে থাকে গ্রামে। এই ঘটনা তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের কানে যে যায়নি, তা নয়। একটি ঘটনাই তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

কী সেই ঘটনা?

মাস খানেক আগেই ভাঙড়ের পোলেরহাটে এক সভায় জেলা তৃণমূল সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘পাওয়ার গ্রিডের বিরুদ্ধে আন্দোলন বরদাস্ত করা হবে না। আন্দোলন কী ভাবে সামলানো যায়, আমি জানি।’’ সেই সভায় আরাবুল এলেও প্রথমে মঞ্চে ওঠেননি। নেতাদের ডাকাডাকিতেও সাড়া দেননি। শেষমেশ শোভনবাবু ধমকানি দিয়ে তাঁকে মঞ্চে নিয়ে আসেন। শোভনবাবুর সেই প্রকাশ্য ধমকানি সত্ত্বেও কিন্তু আন্দোলন দমে যায়নি। আন্দোলন যখন ভিতরে ভিতরে দানা বাঁধছে, তখন অনেক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা বাম শিবির থেকে আসা রেজ্জাককে দূরে রাখতে আরাবুলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কারণ, রেজ্জাক সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন। এর মধ্যে রেজ্জাকের হাত ধরে সিপিএমের অনেক কর্মীই তৃণমূলে ঢুকে পড়েছেন। তাঁদের দাপটে আরাবুল-সহ তৃণমূল আদি কর্মীরাও অনেকটাই কোণঠাসা। এঁরাই আরাবুলের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলতে থাকেন। আরাবুল অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়।’’ এলাকার এক বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘আরাবুলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে। দল যদি ওঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিত, তা হলে মঙ্গলবার ভাঙড়ের এই অবস্থা হয়তো হতো না।’’ তৃণমূলের একাংশ বলছেন, ক্রমশ কোণঠাসা হতে হতে আরাবুল শেষ পর্যন্ত পাওয়ার গ্রিডের আন্দোলনকেই তাঁর অস্তিত্ব রক্ষার অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করতে থাকেন।

ভাঙড়-কাণ্ডের ময়না-তদন্তে অবশ্য শুধু আরাবুলের নামই আসছে না। এক গোয়েন্দা-কর্তা জানান, জমি আন্দোলনের গন্ধ পেয়ে নকশাল নেতাদের একাংশও জমি রক্ষা কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। পাওয়ার গ্রিডে গ্রামের যে লোকরা কাজ পাননি, তাঁদেরও আন্দোলনে সামিল করা হয়। এ মাসের গোড়ায় এক নকশাল নেতা ভাঙড়ে সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গি গণ-আন্দালনের ডাক দেন। আরাবুলের হাত থেকে এই আন্দোলন অনেকটাই চলে যায় নকশালদের অধীনে। নকশালদের সঙ্গে যোগ দেয় রাজারহাটের জমি আন্দোলনকারীরাও। তাতে নকশালদের শক্তি বাড়ে। আরও দুর্বল হন আরাবুলরা।

তৃণমূলের এক নেতা বলেন, ‘‘যে খেলা শুরু করেছিল আরাবুল, তা নকশালদের হাতে চলে যাওয়ায় আরাবুলের মদতদাতা শীর্ষনেতারাও বিপাকে। কারণ, তাঁরা ভেবেছিলেন, এতে রেজ্জাক কোণঠাসা হয়ে গেলেই ফের আরাবুলকে দিয়েই আন্দোলনের দৈত্যকে বোতলবন্দি করা যাবে। কিন্তু নকশালরা সেই চাল কাঁচিয়ে দেয়।’’

আন্দোলনে নকশালদের উপস্থিতির কথা বলছেন স্থানীয়েরাও। পোলেরহাটের একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘‘পরিযায়ী পাখিরা এসেই গোলমাল করল।’’ জমি রক্ষা কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘‘সোমবার দুই সদস্যকে সিআইডি আটক করার পরে আমাদের প্রধান নেতা ফোন করে পুলিশ সুপারকে ধমকান। এখনই ছেড়ে দেওয়ার দাবি করেন। ফোন রেখেই তিনি পুলিশের সঙ্গে জঙ্গি লড়াইয়ে নামার কথা বলেন। তারপরই আন্দোলন।’’ সিআইডি-র এক কর্তা জানিয়েছেন, ভাঙড়ে জমি-আন্দোলনের শিকড় অনেক দূর ছড়িয়ে গিয়েছে। অন্ধ্রপ্রদেশ ও কেরলের মাওবাদী নেতারাও যোগাযোগ করছেন বলে খবর এসেছে। এলাকা থেকে পুরোপুরি জমি হারিয়েছে আরাবুল এবং রেজ্জাক। দু’জনের কেউই তাই ঘটনাস্থলের আশপাশে কার্যত ঢুকতে পারছেন না। তৃণমূলের নিজের এলাকাই এখন তাই হয়ে গিয়েছে ‘নকশালদের মুক্তাঞ্চল’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Arabul Islam TMC Bhangar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE