Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তৃণমূলের বিক্ষোভ দেখে অবাক অসম-ওড়িশা

বাধা দিচ্ছে শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল। সারদা-সহ বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআইকে অসম বা ওড়িশায় কোনও সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে না। পড়শি রাজ্যগুলির তুলনায় একেবারে বিপরীত মেরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও তাঁর সরকার।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৮
Share: Save:

বাধা দিচ্ছে শুধু পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল।

সারদা-সহ বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে সিবিআইকে অসম বা ওড়িশায় কোনও সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে না। পড়শি রাজ্যগুলির তুলনায় একেবারে বিপরীত মেরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও তাঁর সরকার।

তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে বিক্ষোভে বসেছে তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস। যার নেতৃত্বে রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। সিবিআই অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছে, এই চাপের কাছে তারা মাথা নোয়াবে না। তৃণমূলের বিক্ষোভকে গুরুত্ব না দিয়ে সিবিআইয়ের সিদ্ধান্ত, প্রয়োজনে তৃণমূল নেতাদের সিবিআই দফতরে না ডেকে অন্য কোথাও জেরা করা হবে।

বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ সামিল হয়ে রাজ্যের আইনমন্ত্রীর অভিযোগ, সিবিআই তদন্তের পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। তিনি বলেন, “সিবিআই যন্ত্র, নরেন্দ্র মোদী যন্ত্রী। শুধু বেছে বেছে তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতার ও জেরা করা হচ্ছে। তৃণমূলকে কালিমালিপ্ত করাই সিবিআইয়ের এক মাত্র উদ্দেশ্য।”

এর উল্টো ছবি কিন্তু অসম ও ওড়িশায়। তরুণ গগৈ ও নবীন পট্টনায়েক দু’টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই বিজেপি-বিরোধী শিবিরের দলনেতা। এক জন কংগ্রেস, অন্য জন বিজু জনতা দল। পশ্চিমবঙ্গের মতো ওই দুই রাজ্যেও শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের জেরা করা হয়েছে কিংবা তাঁদের বাড়িতে তল্লাশি চলেছে। কিন্তু তরুণ বা নবীন, কেউই এখনও পর্যন্ত সিবিআই তদন্তের পিছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেননি। মমতার মতো দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিক্ষোভ দেখানোরও নির্দেশ দেননি। দু’জনেরই ঘোষিত অবস্থান, সিবিআই তদন্তে সব রকম সহযোগিতা করা হবে। অসম ও ওড়িশার শাসক দলের নেতারা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের মনোভাব দেখে বিস্মিত। তাঁদের যুক্তি, এই ভাবে সিবিআইয়ের কাজে বাধা দেওয়া উচিত নয়।

সিবিআই বুঝিয়ে দিয়েছে, তৃণমূলের এই বিক্ষোভ বা চাপের রাজনীতির কাছে তারা মাথা নোয়াবে না। সিবিআই অধিকর্তা রঞ্জিত সিন্হা কলকাতার তদন্তকারী অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছেন, তৃণমূলের আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তদন্ত, জেরা যেমন চলছে, তেমনই চালিয়ে যেতে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কোনও রকম গণ্ডগোলে জড়িয়ে না পড়তেও কলকাতার তদন্তকারীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সিবিআইয়ের শীর্ষ স্তর থেকে।

সিবিআইয়ের এক শীর্ষ সূত্রের কথায়, “ওড়িশা বা অসমে কোনও সমস্যা নেই। সল্টলেকে দফতরের বাইরে যতই গণ্ডগোল হোক, ভিতরে তদন্তের কাজ যেমন চলছে, চলবে। তৃণমূল নেতাদেরও প্রয়োজনে ডেকে জেরা করা হবে। তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুকে আজ, শুক্রবার বা কাল, শনিবার ফের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে। সল্টলেকের অফিসের বাইরে গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা হলে ওঁকে আমরা অন্য কোথাও জেরা করব।” তার পরেও বাধা এলে বা রাজ্য প্রশাসন অসহযোগিতা করলে পরবর্তী রণকৌশলের কথা ভাবা হবে। প্রাথমিক ভাবে তৃণমূলের এই বিক্ষোভকে গুরুত্ব না দিলেও রাজ্যের আইনমন্ত্রী যে ভাবে পথে নেমেছেন, তাতে সিবিআই কর্তারা যথেষ্টই বিস্মিত।

আইনমন্ত্রী হয়ে কী ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরের সামনে ধর্নায় বসছেন? চন্দ্রিমার জবাব, “আইনমন্ত্রী যেমন একটি সত্তা, তেমন রাজনৈতিক সত্তাও আছে। আমি তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের চেয়ারপার্সন। আমরা চাই সিবিআই সঠিক ভাবে তদন্ত করুক।” তা হলে এমন ভাবেই আন্দোলন চলবে? আইনমন্ত্রীর জবাব, “এই আন্দোলনই বাংলা দেখে এসেছে। এই আন্দোলনই বাংলা চেনে।” সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কেন? চন্দ্রিমার ব্যাখ্যা, “সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য সিবিআইকে বলেছিল। কিন্তু সিবিআই তদন্তের অভিমুখ বদলাচ্ছে। সিপিএম, সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কাউকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে না।” এই সঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “সিবিআই ডিরেক্টর রঞ্জিত সিন্হা নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত।”

পশ্চিমবঙ্গের আইনমন্ত্রী সিবিআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অভিযোগ তুললেও অসম ও ওড়িশার শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা কিন্তু এই অভিযোগের কোনও সারবত্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। বিজু জনতা দলের নেতা মেহতাবের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গে যেটা হচ্ছে, সেটা হওয়া উচিত নয়।” অসমের কংগ্রেস নেতা, মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-র মিডিয়া উপদেষ্টা ভরত নরহ্ বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে শাসক দলের অনেকে এই ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ উঠছে। সারদার সঙ্গে তৃণমূলের বিভিন্ন ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথাও শোনা যাচ্ছে। তাই ওদের সিবিআইকে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।”

সারদা মামলায় অসমের প্রভাবশালী বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, অঞ্জন দত্তের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চলছে। কংগ্রেস সরকারের একাধিক মন্ত্রী-বিধায়কের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী রাজেশ বজাজ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা কংগ্রেস সাংসদ মাতঙ্গ সিংহ, হিমন্ত-ঘনিষ্ঠ শিল্পী সদানন্দ গগৈ, রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন দুই ডিজি জি এম শ্রীবাস্তব ও শঙ্কর বরুয়ার বাড়িতেও তল্লাশি হয়েছে। একই ভাবে ওড়িশায় চিট ফান্ড কেলেঙ্কারিতে রাজ্যের খাদ্য সরবরাহমন্ত্রী সঞ্জয় দাসবর্মাকে সিবিআই জেরা করেছে। শাসক দলের সাংসদ রামচন্দ্র হাঁসদা, বিধায়ক প্রভাত ত্রিপাঠি, প্রাক্তন বিধায়ক সুবর্ণ নায়েকের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। তার পরেও রাজ্যের শাসক দল কিন্তু সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে মাঠে নামেনি। সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসাররা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ওড়িশায় বিজেপি নেতার বাড়িতেও তল্লাশি হয়েছে।

তৃণমূলের পথে হেঁটে অসমে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। তিনি বলেছেন, “আমি অনেক দিন ধরেই সিবিআই তদন্ত চাইছি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তৃণমূল বাধ্য হয়ে তদন্ত শুরু করেছে। যারা এত মানুষকে প্রতারণা করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।” বিজেডি নেতা মেহতাব বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সিবিআইকে সাহায্য করা হবে। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি চাই আমরা।” সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, “সিবিআই রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি অনেক অরাজনৈতিক লোকজনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কোথাও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে না।” অসমের কংগ্রেস নেতা ভরত নরহ্র যুক্তি, “অসমে প্রদেশ কংগ্রেস সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত নয়। তাই আমাদের কোনও ভয় নেই। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ প্রতারণায় জড়িত থাকলে শাস্তি পাবেন।”

পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, তৃণমূল যে ভাবে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে নেমেছে, তাতে প্রমাণিত হচ্ছে তারা সারদা-কেলেঙ্কারিতে জড়িত। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, “সিবিআই তো এখনও বলেনি তৃণমূল দায়ী। আসলে তৃণমূল ভয় পাচ্ছে। তদন্ত যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে মমতাকে জেলে যেতে হবে। তাই ওঁরা আতঙ্কিত। মমতার নির্দেশেই তাই আইনমন্ত্রী রাস্তায় নেমেছেন।” সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মমতার বৈঠক নিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর বক্তব্য, “মধ্য রাতে এক ঘণ্টা বৈঠক হয়েছিল। ভদ্রলোকে এত রাতে মিটিং করে না! সবটাই গোপনীয়তা রাখার জন্য। ব্যক্তিগত ভাবে আলাপ করেছে, পরামর্শ দিয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে, এখন বলছে চিনি না!” আইনমন্ত্রীর বিক্ষোভে বসা নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “আর কিছু যেন বেরিয়ে না আসে, সেটা আটকানোর চেষ্টা করছেন উনি। এক দিকে বিক্ষোভ, অন্য দিকে বিজেপি-সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ে যেতে পারে।” সমীর চক্রবর্তীকে জেরা করার পর বৃহস্পতিবার তাঁর স্ত্রী, তৃণমূল নেত্রী কৃষ্ণা চক্রবর্তীর বিক্ষোভে বসা নিয়েও কটাক্ষ করেছেন বিমান। তাঁর কথায়, “যাঁদের স্বার্থে ঘা লেগেছে, তাঁরাই নিজেদের বাঁচানোর জন্য সব রকম চেষ্টা করছেন।”

চন্দ্রিমার বিক্ষোভে বসার মধ্যে অন্য অর্থ খুঁজে পেয়েছেন বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। উনি যে রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে সিদ্ধার্থনাথের বক্তব্য, “সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়েই তৃণমূলের নেতারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাই স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রীকে ওখানে হাজির থাকতে হচ্ছে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE