গ্রামে তাণ্ডবের আতঙ্কে এলাকা ছাড়ছেন মাখড়া গ্রামের বাসিন্দারা।
দুপুর দেড়টা। মাখড়া গ্রামের দক্ষিণপাড়ার কংক্রিটের রাস্তায় দেখা মিলল হালিমা বিবির। সঙ্গে বছর চারেকের মেয়ে। হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে হনহন করে হাঁটছেন। মুখেচোখে আতঙ্ক। কোথায় যাচ্ছেন, জানতে চাওয়ায় বললেন, “গ্রামই ছাড়ছি!”
কেন ছাড়ছেন?
বছর সাতাশ-আঠাশের অন্তঃসত্ত্বা হালিমার জবাব, “এ দিন আমাদের গ্রামে যা হল, তার পরে আর কোন ভরসায় এখানে থাকব। আমার স্বামী আগেই পালিয়েছেন। বাড়ির উঠোনে বোমা মারল তৃণমূলের গুন্ডারা। ভয়ে পড়ে যাই। চিকিত্সক জানিয়েছেন, আগামী মাসেই আমার সন্তান জন্ম দেওয়ার কথা। জানি না, পড়ে যাওয়ার ফলে গর্ভস্থ সন্তানের কী হবে!” জানালেন, ইলামাবাজারে বাপের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।
শুধু হালিমা বিবিই নয়, এ দিন সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনীর হামলার পর থেকে আতঙ্কে কাঁটা হয়ে রয়েছেন মাখরার অধিকাংশ সাধারণ মানুষই। হালিমার মতোই গ্রাম ছেড়েছেন আরও অনেক মহিলা। তাঁদের মধ্যে অনেকে তৃণমূল সমর্থক। অনেকে বিজেপি সমর্থক পরিবারের বউ বা মেয়ে। কিছুটা এগোতেই স্থানীয় হাঁসড়া বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী রেশমা খাতুন পথ আটকাল। মা ফজিলা বিবিকে ডেকে নিয়ে রেশমা বলল, “এ দিন সকালে বাবা শেখ জিয়ার আলিকে পুলিশ শাসিয়ে গিয়েছে, যে কোনও সময় গ্রেফতার করবে। আমার বাবার দোষ, তিনি বিজেপি করেন।” দক্ষিণপাড়ার যে-সব বাড়িতে এ দিন তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব ও লুঠপাট চালিয়েছে বলে অভিযোগ, তারই একটি হল রেশমাদের বাড়ি। রেশমার কথায়, “তৃণমূলের গুন্ডারা এ দিন আমাদের বাড়িতে ঢুকে বোমা ছুড়েছে। সোনাদানা, টাকা লুঠ করেছে।, বাড়ির আসবাবপত্র ভেঙে তছনছ করেছে। আমাকে অশ্রাব্য গালিগালাজও করে।” প্রতিবেশী আঙ্গুরা বিবির অভিযোগ, স্থানীয় কাচপুকুর পাড়ে বসে পরের পর বোমা বেঁধেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। সেখান থেকে নাগাড়ে বোমা ছোড়া হয়েছে দক্ষিণপাড়ায়।
দক্ষিণপাড়া ক্যানালের ও-পারে বিজেপি সমর্থক শেখ আজহারউদ্দিনের ছেলে শেখ সুজলের বিয়ে ছিল আজ, মঙ্গলবার। সেই উপলক্ষে বাড়িতে সাজোসাজো রব। আত্মীয়-পরিজনেরা এসেছেন। বাড়ির উঠোনে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল প্যান্ডেল। এ দিন দুপুরের রান্নার তোড়জোড় চলছিল। সেই সময়ই আচমকা দুষ্কৃতীরা হানা দেয় সেখানে। আজহারাউদ্দিন বলেন, “দুষ্কৃতীরা ঢুকেউ বোমা আর গুলি চালাতে শুরু করল। লন্ডভন্ড করে দেয় প্যান্ডেল। চেয়ার ভেঙে দেয়। বাড়ির লোকেরা যে যেমন পেরেছে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়েছে। ছেলের বিয়ে কী ভাবে হবে, কনে যাত্রীরা কী ভাবে আসবেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।”
ঘটনার পরে মাখড়ায় পুলিশি টহল।
দুপুর পৌনে ৩টে।
দক্ষিণপাড়া ক্যানাল লাগোয়া মসজিদের উঠোনে যন্ত্রণায় গোঙাছিলেন গ্রামের দাপুটে তৃণমূল নেতা শেখ এনামুল হক। সারা শরীর রক্তে ভিজে গিয়েছে। গায়ে মারধরের ক্ষতচিহ্ন। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে প্রথমেই বললেন, “আমাকে বাঁচান। বিজেপি-র লোকেরা মেরে ফেলবে।” খবর পেয়ে চলে আসেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায় এবং বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব। পুলিশ রক্তাক্ত এনামুলকে তুলে নিয়ে গাড়িতে করে সিউড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশকর্তাদের জানালেন, ক্যানালের আগে ঢালাই রাস্তার ধারে একটি বাড়িতে পড়ে রয়েছেন এনামুলের ভাই, এলাকার তৃণমূল কর্মী শেখ মোজাম্মেল হক। তাঁকেও বেধড়ক মারধর করেছে গ্রামের বিজেপি কর্মীদের একাংশ বলে তৃণমূলের অভিযোগ। মোজাম্মেলকেও গাড়িতে তুলে সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি মারা যান। গাড়িতে তোলার সময় মোজাম্মেলের দিদি মমতা বিবি ছুটে এসে ভাইয়ের মুখে জল দিলেন।
চৌমণ্ডলপুর গ্রামের আগেই পুলিশ আটকে দিল বিজেপি-র প্রতিনিধি দলকে।
তার আগেই অবশ্য স্থানীয় বিজেপি সমর্থক শেখ ইসমাইল নিজে জল এনে মোজাম্মেলকে দিয়েছেন।
বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে অশান্ত মাখড়ায় যা সোমবার এক ব্যতিক্রমী ফ্রেম হিসাবেই থেকে গেল! ইঙ্গিত রেখে গেল, রাজনৈতিক শত্রুতাই শেষ কথা নয়। সহমর্মিতা বলেও একটা শব্দ এখনও তাঁদের অভিধানে আছে।
ছবি: বিশ্বজিত্ রায়চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy