Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
নিশানায় শাসক দল

বিধানসভা ভোটের আগে ১০ স্যুটকেস, নজর সিবিআইয়ের

শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়ক হর্ষদ মেটার স্যুটকেস-কাণ্ড এক সময়ে তোলপাড় করেছিল দেশের রাজনীতি। খোদ হর্ষদের দাবি ছিল, স্যুটকেসে কোটি টাকা ভরে তিনি দিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের হাতে! ওই অভিযোগের অবশ্য প্রমাণ মেলেনি। প্রায় কুড়ি বছর পরে ফের স্যুটকেস-তদন্তে নেমেছে সিবিআই। তবে এ বার আর একটি নয়, দশ-দশটি স্যুটকেস ভর্তি টাকা নিয়ে শুরু হয়েছে তদন্ত। এ বার অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম শীর্ষ কয়েক জন নেতা।

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়ক হর্ষদ মেটার স্যুটকেস-কাণ্ড এক সময়ে তোলপাড় করেছিল দেশের রাজনীতি। খোদ হর্ষদের দাবি ছিল, স্যুটকেসে কোটি টাকা ভরে তিনি দিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের হাতে! ওই অভিযোগের অবশ্য প্রমাণ মেলেনি।

প্রায় কুড়ি বছর পরে ফের স্যুটকেস-তদন্তে নেমেছে সিবিআই। তবে এ বার আর একটি নয়, দশ-দশটি স্যুটকেস ভর্তি টাকা নিয়ে শুরু হয়েছে তদন্ত। এ বার অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম শীর্ষ কয়েক জন নেতা। সারদা-কর্তার দেওয়া নগদ টাকার বান্ডিল ১০টি লাল ট্রলি-স্যুটকেসে ভরে ওই নেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। ওই টাকা গত বিধানসভা নির্বাচনে খরচও করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে সিবিআই সূত্রে। অভিযোগের তির শাসক দলের দিকেই।

কত টাকা ছিল ওই দশটি স্যুটকেসে? সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, দশটি স্যুটকেসে ছিল মোট ১২৫ কোটি টাকা। বিধানসভা নির্বাচনের মাসতিনেক আগে নগদ ওই টাকা নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বলে জেরায় জানিয়েছেন সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন নিজেই।

কিন্তু সুদীপ্ত যে ঠিক বলছেন, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সারদা-কর্তাকে জেরা করার পরে এই প্রশ্নই উঠে এসেছিল তদন্তকারীদের মনে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাঁরা জেরা করেন সুদীপ্তের ওই সময়ের সঙ্গী দেবযানী মুখোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষ এবং সারদা-কর্তার ঘনিষ্ঠ কয়েক জন গাড়ির চালককে। তদন্তকারীদের দাবি, সারদার মিডল্যান্ড পার্ক অফিস থেকে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে মোট পাঁচ দফায় ১২৫ কোটি টাকা সুদীপ্তের দুই গাড়িচালক ওই নেতাদের দিয়ে এসেছিলেন বলে জেরায় জানা গিয়েছে। এর পরেই সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জেরা করেন ওই সব নেতাদের কয়েক জন ছায়াসঙ্গীকে। জেরার মুখে পড়ে তাঁরাও এই তথ্য মেনে নিয়েছেন বলে তদন্তকারীরা জানান। সিবিআই সূত্রের খবর, এক জনের সঙ্গে অন্য জনের বক্তব্য মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সব ক’জনের বক্তব্যই মোটামুটি এক। রাজ্য পুলিশের এক প্রাক্তন ডিজি-ও সম্প্রতি এ ব্যাপারে তদন্তকারীদের সাহায্য করেছেন বলে খবর। তদন্তকারীদের দাবি, শাসক দলের এক প্রাক্তন নেতার কাছ থেকেও এই বিষয়ে তথ্য মিলেছে।

টাকা নিয়ে কী করেছেন ওই নেতারা? তদন্তকারীরা জেনেছেন, ওই টাকার একটি বড় অংশ বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের দেওয়া হয়েছিল। এক এক জন প্রার্থীকে মোটামুটি ২২ লক্ষ করে টাকা দেওয়া হয়েছিল। কোনও কোনও প্রার্থী অবশ্য ৩০ লক্ষ টাকাও পেয়েছেন বলে জেরায় জানা গিয়েছে। সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, প্রার্থীদের দেওয়া টাকার হিসাব দেখানো হয়েছে অভিনব পদ্ধতিতে! ভবানীপুর এলাকার একটি ছাপাখানা থেকে প্রায় চার লক্ষ টাকা খরচ করে ১০০, ৫০০ ও হাজার টাকার কয়েক লক্ষ কুপন ছাপা হয়েছিল। কুপনে লেখা ছিল ‘নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ’। তদন্তকারীরা জেনেছেন, যে প্রার্থীকে যত টাকা দেওয়া হয়েছিল, তত টাকার কুপনও তাঁকে দেওয়া হয়। ওই কুপনের বাইরের অংশটি (কেউ চাঁদা দিলে তাঁকে যে অংশটি দেওয়া হয়) কেটে বস্তাবন্দি করে দলীয় অফিসে রাখা হয়েছিল। ভিতরের অংশটি (যেটি দলের কাছে থাকে) প্রার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। পরে বস্তাবন্দি কুপনের বাইরের অংশটি ইএম বাইপাসের নোনাডাঙ্গা এলাকার একটি বড় জলাশয়ের কাছে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জেরায় এমন তথ্যই জানা গিয়েছে বলে সিবিআই সূত্রের দাবি।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এই তথ্য পাওয়ার অনেক আগেই অবশ্য সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছিলেন। বিধানসভা ভোটের আগেই তিনি কুপন কেলেঙ্কারির অভিযোগ এনেছিলেন তৃণমূলের কয়েক জন নেতার বিরুদ্ধে। দাঁতের সমস্যায় কাতর গৌতমবাবু মঙ্গলবার কথা বলতে পারেননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হয়েছে, “গৌতমবাবু ওই অভিযোগ করার পরে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করা হয়েছিল তৃণমূলের তরফে। মামলার বহু শুনানি পেরিয়ে গেলেও অভিযোগকারীই আদালতে হাজিরা দেননি! গৌতমবাবু তো বলেইছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে কুপন কেলেঙ্কারির অভিযোগ, হয় তাঁরা জেলে যাবেন, নয়তো তিনি!”

সারদা-কাণ্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা নিয়ে গিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। তাঁর বক্তব্য, “ওই নির্বাচনে তৃণমূল যা খরচ করেছিল, তা কোনও সর্বভারতীয় দলও করতে পারেনি! মানুষ সব দেখেছে। এই খরচের হিসাব তৃণমূল নেতৃত্বকে দিতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রির টাকায় ওই নির্বাচনী খরচ যে মেটানো যায় না, তা সবাই জানে!” সিপিএম নেতা গৌতমবাবুই যে মূলত এই বিষয়ে অভিযোগ সামনে এনেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ টেনেই এ দিন মান্নান আরও বলেন, “সঠিক তদন্তে সব প্রমাণ হবে। তৃণমূল তদন্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। জয়ললিতাও পার পাননি, মমতাও পাবেন না!”

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, “তৃণমূল শুধু বিধানসভা ভোটের খরচই নয়, সারদার টাকায় অন্য দলের বিধায়ক কেনা, দল ভাঙানোর কাজ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে! মমতা প্রস্তুত হোন, মানুষ জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে!” আর বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের বক্তব্য, “ওই ভোটে তৃণমূলের খরচ রাজ্যের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল! টাকার উৎস কী, খোঁজ নেওয়া দরকার।” তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য মন্তব্য করতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha scam sudipto sen debjani subhasish ghatak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE