Advertisement
০৪ মে ২০২৪
অভিযুক্ত তৃণমূল

সিপিএম কর্মীর স্ত্রীকে গণধর্ষণ, খুন

গণধর্ষণ করে খুন এবং তার পরে মৃতার দেহ ঝুলিয়ে রেখে যাওয়া। উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁ গ্রামের এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এ রাজ্য আগেই দেখেছে। অভিযোগ, সোমবার আরও এক বার তার সাক্ষী থাকল পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে সুনিয়া গ্রাম। তবে এ বার মৃতাকে গাছে নয়, তাঁর নিজের বাড়িরই একটি ঘরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ দিন ভোরে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ দেবাশিস ভুঁইয়া-সহ ১২ জনের নামে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেছেন মৃতার স্বামী।

কাঁথিতে প্রতিবাদ সভায় সিপিএম নেতা তাপস সিংহ।  নিজস্ব চিত্র

কাঁথিতে প্রতিবাদ সভায় সিপিএম নেতা তাপস সিংহ। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কাঁথি শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

গণধর্ষণ করে খুন এবং তার পরে মৃতার দেহ ঝুলিয়ে রেখে যাওয়া।

উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁ গ্রামের এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি এ রাজ্য আগেই দেখেছে। অভিযোগ, সোমবার আরও এক বার তার সাক্ষী থাকল পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে সুনিয়া গ্রাম। তবে এ বার মৃতাকে গাছে নয়, তাঁর নিজের বাড়িরই একটি ঘরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এ দিন ভোরে তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতির কৃষি কর্মাধ্যক্ষ দেবাশিস ভুঁইয়া-সহ ১২ জনের নামে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেছেন মৃতার স্বামী। মৃতার পরিবার সিপিএম, এবং অভিযুক্তেরা তৃণমূল হওয়ার দরুণ ঘটনাটি রাজনৈতিক রং নিয়েছে।

মৃতা (৪৩) নিজে সিপিএমের স্থানীয় মহিলা কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর স্বামী দলের নামালডিহা লোকাল কমিটির সদস্য। এলাকায় এক সময় তাঁর যথেষ্ট দাপট ছিল। রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে তিনি ঘরছাড়া। জেলার তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য এই ঘটনায় তৃণমূলের কারও জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভিযুক্তরা এলাকা ছেড়ে ফেরার।

মৃতার পরিবারের তরফে তৃণমূল কর্মীদের পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও কিন্তু গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। মৃতার দেওর লিখিত অভিযোগে দাবি করেছেন, কাঁথি থানার পুলিশ প্রথমে তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে নেয় যে, এটি আত্মহত্যার ঘটনা। পরে মৃতার স্বামীর অভিযোগ পেয়ে শেষ পর্যন্ত পুলিশ খুন ও গণধর্ষণের মামলা দায়ের করেছে। তবে সোমবার সন্ধের পরে জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা সংবাদমাধ্যমকে ফোন করে দাবি করেন, ময়নাতদন্তে প্রাথমিক ভাবে ধর্ষণ বা খুনের প্রমাণ মেলেনি। উল্টো দিকে গত লোকসভা ভোটে কাঁথি কেন্দ্রে পরাজিত সিপিএম প্রার্থী তাপস সিংহর অভিযোগ, “মারাত্মক একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার পরে এখন ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করছে তৃণমূল।”

জেলার এসপি গোড়া থেকেই প্রকৃত ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করেছেন বলে আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্তকে ফোন করে অভিযোগ জানান দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব-ও। তাঁদের দাবি, ময়নাতদন্তের পরে চিকিৎসককে চাপ দিয়ে লেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, এটা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নয়। পুলিশ সুপার সুকেশ কুমার জৈন এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এখনও হাতে পাইনি। রিপোর্ট নিয়ে কাউকে চাপ দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা।”

এ দিন কাঁথি থানার সামনে মৃতা মহিলার দেহ রাস্তায় রেখে বিক্ষোভ দেখায় সিপিএম। দুষ্কৃতীদের ধরার দাবিতে আজ, মঙ্গলবার রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল করা হবে বলে জানান রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে বিজেপিও। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহর দাবি, প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনাতেই তৃণমূল কোনও না কোনও ভাবে জড়িত থাকছে। “সরকারের কাছে অনুরোধ, এ বার তারা সুস্থ বুদ্ধির পরিচয় দিক। নইলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।”

প্রশাসনের তরফে অবশ্য ঘটনার প্রকৃত তদন্ত হবে বলেই আশ্বাস মিলেছে। তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, “যে-ই করে থাকুক, প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নেবে। দোষীরা ছাড় পাবে না।”

গত মাসের ২৪ তারিখ পূর্ব মেদিনীপুরেরই নন্দকুমার থানা এলাকায় এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাটি সামনে আসার পরে গণপ্রহারে মারা যায় অভিযুক্ত প্রৌঢ়। কাঁথির সুনিয়া গ্রাম কিন্তু কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছে। ভেড়িবহুল এলাকাটি তেমন জনাকীর্ণ নয়। বাসিন্দাদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী। মৃতার স্বামীও ভেড়িতে বাগদা চাষ করতেন। ঘরছাড়া হয়ে তিনি এখন ছেলেকে নিয়ে রামনগরে থাকেন। তাঁর স্ত্রী অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী হওয়ায় গ্রামের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি-দেওর ও জা’য়ের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলেন। সিপিএম নেতা তাপসবাবু জানিয়েছেন, ঘরছাড়া থাকায় তাঁদের ছেলে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারেনি। বধূর দেওরের অভিযোগ, এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় দেশপ্রাণ ব্লকের যুব তৃণমূলের সম্পাদক তথা পঞ্চায়েত সমিতির নেতা দেবাশিসবাবুর নেতৃত্বে তৃণমূল কর্মীরা কিছু দিন ধরেই তাঁদের হুমকি দিচ্ছিল। তাদের দাবি ছিল, হয় তাঁর দাদাকে এলাকায় ফিরিয়ে আনতে হবে, না-হলে ১২ লাখ টাকা দিতে হবে। গত শুক্রবার তাঁদের বাড়িতে অস্ত্র রয়েছে বলেও অভিযোগ তোলে তৃণমূলের লোকজন।

ওই যুবকের অভিযোগ, শুক্রবারই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে দু’দিন ধরে মারধর করার পরে রবিবার বিকেলে তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেন দেবাশিসবাবু ও তাঁর দলবল। নিগৃহীতের দাবি, “তখনই ওরা বৌদিকে পাকড়াও করে। প্রথমে ১২ লক্ষ টাকা চান। দাদাকে এলাকায় ফিরিয়ে আনতে হবে বলে দাবি করে। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ওরা বৌদিকে মারতে মারতে বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যায়।” কিছু ক্ষণ পরে ছাড়া পেয়ে মহিলা বাড়ি ফিরে এসেছিলেন বলে পরিবার সূত্রে জানানো হয়েছে। কিন্তু গভীর রাতে ফের তাঁকে বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে শুনশান জগদীশ মোড়ে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের পরে খুন করা হয় বলে অভিযোগ।

মৃতার দেওর জানান, ভয়ে তাঁরা বাড়ি থেকে বেরোননি। এ দিন ভোরে তাঁদের মাটির বাড়ির দোতলার ঘরে বৌদির ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান তাঁরা। প্রথমে এক প্রতিবেশীর ফোন থেকে সিপিএম স্থানীয় নেতাদের ঘটনার খবর দেন তাঁরা। তাঁদের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ গ্রামে যায়। সে সময়েই তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে জোর করে খুনের অভিযোগ লিখিয়ে নেওয়া হয় বলে মৃতার দেওরের দাবি। তাঁকে যে দেবাশিসবাবুরা তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করেছিলেন, তৃণমূলের ভয়েই তখন পুলিশের কাছে সেই অভিযোগ তিনি করতে পারেননি বলেও দাবি। সে সময়ে তাঁর মোবাইলটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে এ দিন তিনি সেই ঘটনার কথা পুলিশের কাছে পৃথক অভিযোগে জানিয়েছেন। এ দিনই মহিলার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।

ঘটনার পরে সিপিএম-তৃণমূল নির্বিশেষে গ্রামের সকলেই চুপচাপ রয়েছেন। কেউ বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেউ বলছেন ঘটনার কথা জানি না। যেমন মৃতার প্রতিবেশী শশাঙ্ক মণ্ডল বলেন, “রবিবার রাতে আমি মাছ চাষের পুকুরে ছিলাম। এ দিন সকালে এসে জানলাম এমন ঘটেছে।” তবে তিনি স্বীকার করছেন, রবিবার সন্ধ্যায় এলাকায় ছিলেন। তখন ওই বধূকে রাস্তায় মারধর করারর দৃশ্য তিনি দেখেছেন। তবে কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। ভয়ে কাউকে কিছু বলেনওনি।

তবে এই ঘটনায় তাঁর দলের কেউ জড়িত নন বলেই দাবি সাংসদ শুভেন্দুবাবুর। তাঁর কথায়, “সিপিএম তো যা ইচ্ছে অভিযোগ করতে পারে। কিন্তু তৃণমূল এতটা দেউলিয়া হয়ে যায়নি যে, এমন কাণ্ড ঘটাবে।”

কাঁথির ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র যুবর বিক্ষোভ-মিছিল

মেদিনীপুরে মিছিল। নিজস্ব চিত্র।

কাঁথির ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার সন্ধ্যায় মেদিনীপুর শহরে মিছিল করে সিপিএমের ছাত্র- যুব সংগঠন। সংগঠনের জেলা কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। পরে তা শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রমা করে। নেতৃত্বে ছিলেন ডিওয়াইএফের জেলা সম্পাদক দিলীপ সাউ, এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক সৌগত পণ্ডা প্রমুখ। ডিওয়াইএফের জেলা সম্পাদক দিলীপ বলেন, “শুধু পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি নয়, রাজ্যের বিভিন্ন এলাকাতেই মহিলাদের উপর আক্রমণ- নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। পুলিশ- প্রশাসন উদাসীন।” এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক সৌগত বলেন, “আমাদের রাজ্য কোনও কিছুতে প্রথম হতে না- পারুক, নারী নির্যাতনে প্রথম! রাজ্যে একজন নারী মুখ্যমন্ত্রী। অথচ, অদ্ভুত ব্যাপার। নারী মুখ্যমন্ত্রী কোনও নারী নির্যাতনের ঘটনায় দু:খপ্রকাশ করেননি। আসলে করেননি তার কারণ, নির্যাতনকারীরা তৃণমূল করে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

contai gangrape cpm cadre tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE