দক্ষিণ থেকে উত্তর— ডেঙ্গি যত দ্রুত ছড়াচ্ছে, যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই টান পড়ছে কিট বা রক্তপরীক্ষার সরঞ্জামে! বৃহস্পতিবার এক দিনেই রাজ্যে ২৮৬ জনের রক্তে ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছে। এই নিয়ে ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হল ২,১৭০। বাগুইআটির ২৩ বছরের এক যুবক রোগী এ দিন মারা গিয়েছেন। মশাবাহিত ওই রোগে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে পনেরোয়।
ডেঙ্গিতে মৃত বাগুইআটির ওই যুবকের নাম রুমন ঘোষ ওরফে বাবান। এ দিন তাঁর মৃত্যু হয়েছে সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁর পরিবার জানায়, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে শনিবার জোড়ামন্দির এলাকার একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন বাবান। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যার পরে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাঁকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। রুমনকে নিয়ে চলতি মরসুমে বিধাননগর পুর এলাকায় ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা পৌঁছল তিনে। দক্ষিণ দমদম এলাকাতেও তিন জন ডেঙ্গি-সংক্রমণে মারা গিয়েছেন।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী অবশ্য জানান, বাগুইআটির বাবান ঘোষের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত আরও কিছু কাগজপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সৃজা ঘোষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে আগে ডেঙ্গির কথা ঘোষণা করা হয়নি। তবে তাঁর মৃত্যু ডেঙ্গিতেই হয়েছে বলে জানিয়ে এ দিন সৃজার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
হুগলির শ্রীরামপুর, কলকাতা এবং তার আশপাশের পুর এলাকাগুলির সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গি সংক্রমণের তালিকায় প্রথম দিকে রয়েছে বাঁকুড়া জেলার নাম। স্বাস্থ্য ভবন থেকে এ দিন যে-তথ্য মিলেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তালিকায় দ্রুত উপরের দিকে উঠে আসছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাও। ওই জেলায় এ দিন ডেঙ্গিতে আরও ১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এই নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছল চৌত্রিশে। ম্যালেরিয়া সংক্রমণের দিক থেকেও পশ্চিম মেদিনীপুর রয়েছে উপরের দিকে।
শিলিগুড়ির পরে উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলাও ক্রমশ ডেঙ্গি-প্রবণ হয়ে উঠছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত পাঁচ জনকে বালুরঘাট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। এই নিয়ে চলতি মাসে ওই জেলায় ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হল ১১। জুন-জুলাইয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরে ১৮ জনের শরীরে ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছিল বলে স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে। ডেঙ্গির প্রকোপ দেখা দিয়েছে শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া ভক্তিনগর এলাকাতেও। ওই এলাকার অন্তত পাঁচ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন ভর্তি আছেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর আগে শিলিগুড়ি পুরসভার ৪১-৩৩ নম্বর ওয়ার্ডেও ডেঙ্গির সংক্রমণ ছড়িয়েছিল।
ওই মারণ-জ্বরের দাপটের মধ্যে কিটের টানাটানিতে রক্তপরীক্ষার কাজ মার খাচ্ছে। কলকাতায় ডেঙ্গির জীবাণু পরীক্ষার পরিকাঠামো ভাল। তাই সেখানে জ্বরের রোগীর দ্রুত রক্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমাণে ডেঙ্গির রক্ত পরীক্ষার কিট না-থাকায় সেখানে রোগ নির্ণয় ঢিমেতালে চলছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। ওই সূত্রেই জানানো হয়, পরীক্ষার জন্য রক্ত দিয়ে এক-এক জনকে তিন-চার দিনেরও বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এর ফলে রোগ নির্ণয়ে দেরি তো হচ্ছেই। সেই সঙ্গে যাঁদের দেহে সংক্রমণ ছড়িয়েছে, যথাসময়ে ঠিকঠাক চিকিৎসার অভাবে তাঁদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঘোরালো হচ্ছে রোগ-পরিস্থিতি। এই অবস্থায় জ্বর, মাথাব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথার উপসর্গ দেখা দিলেই প্যারাসিটামল এবং পর্যাপ্ত জলের সাহায্যে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা শুরু করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য ভবন থেকে।
পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠা সত্ত্বেও রক্তপরীক্ষার পর্যাপ্ত কিট এবং অন্য সরঞ্জামের ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন?
কিট-ঘাটতির দায় কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস (নাইসেড)-এর উপরে চাপিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন। নাইসেড এই ধরনের কিট পায় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছ থেকে। নাইসেড থেকে সেই সরঞ্জাম যায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, রাজ্য থেকে যেমন যেমন চাওয়া হয়, তারা সেই অনুযায়ী কিট সরবরাহ করে। কখনও-সখনও অনুরোধ পাওয়ার পরে কিট সরবরাহে কিছুটা বিলম্ব যে হয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে সেটাও অবশ্য স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
রাজ্যে চলতি মরসুমে ডেঙ্গির সংক্রমণ নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন সোনারপুরে প্রশাসনিক বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘বর্ষাকালে অনেক ধরনের অসুখবিসুখ হয়। আমাদেরও সচেতন হতে হবে। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি তরফে সব রকম নজরদারি রয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy