বারাসতে সিপিএম পার্টি অফিসে উত্তেজিত গৌতম দেব। ছবি: সুদীপ ঘোষ
রাজ্যপাট পরিবর্তনের আগেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরেও তোপ অব্যাহত রেখেছিলেন। তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁকে কখনও তাচ্ছিল্য করেছেন, কখনও মানহানির মামলা ঠুকেছেন। নিজের দলেও প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এ বার সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের ফাঁস তৃণমূলের উপরে চেপে বসতে শুরু করায় ফের মুখ খুললেন গৌতম দেব। এবং মমতা ও তৃণমূলে তাঁর দক্ষিণ হস্ত মুকুল রায়কে ‘দুষ্কৃতী’ আখ্যা দিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এই সদস্য।
কালিম্পঙের কাছে ডেলো বাংলোয় মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা যে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে প্রথম জনসমক্ষে সেই কথা বলেছিলেন গৌতমবাবুই। বরাহনগরে গত বছরের একটি জনসভায় তাঁর সেই মন্তব্যের জন্য তৃণমূলের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। এখন জেলবন্দি তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষের ডায়েরিতেই ডেলো পাহাড়ে মমতা-সুদীপ্তের সেই বৈঠকের কথা বলা হয়েছে। পরিস্থিতি বিচার করেই ফের আসরে নেমেছেন গৌতমবাবু। তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেও মুকুল কেন এক বারও আদালতে হাজির হননি, তুলে দিয়েছেন সেই প্রশ্নও। তাঁর তোলা অভিযোগের কোনও জবাব দেওয়া হয়নি তৃণমূলের তরফে। বরং গৌতমবাবুর শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই ফের কটাক্ষ করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
দলের জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু সোমবার তোপ দাগেন, “মমতা ও মুকুল দু’জনেই দুষ্কৃতী (ক্রিমিনাল)! যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করেছে, সেই সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন আর রোজভ্যালির গৌতম কুণ্ডুকে পাহাড়ে ডেকে নিয়ে ওঁরা
রাত ১২টার সময় বৈঠক করেছেন!” গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, “আসলে মমতা-মুকুল ‘ক্রিমিনাল টাইপ অব পার্সোন্যালিটি! এঁরা মানসিক ভাবেও অপরাধপ্রবণ। ক্রিমিনাল পার্টি হিসেবেই তৃণমূল ইতিহাস হয়ে যাবে!” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রাক্তন এই মন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “মমতা যদি আগে আমার কথা শুনতেন, তা হলে আজ ওঁকে এই দিন দেখতে হতো না! নেতারা লাইন দিয়ে যাচ্ছে, ৭-৮ ঘণ্টা করে জেরা করছে সিবিআই। মদন-ফদন কিস্যু না! সব মমতা জানেন! মুকুল জানেন!”
লোকসভা ভোটের সময় তৃণমূল নেত্রীর পরিবারের লোকজনের অল্প সময়ে ফুলেফেঁপে ওঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন গৌতমবাবু। আলিমুদ্দিনে সেই সাংবাদিক বৈঠকের পরেই রাতে তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়েছিল তৃণমূলের সরকার। এ বারও তো তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে শাসক দল? গৌতমবাবুর বক্তব্য, “আমাকে ওরা জেলে পুরতে চেয়েছিল। পারেনি। আমি তো বলেছি, হয় মুকুল জেলে যাবেন, নয়তো আমি! মমতা জেলে যাবেন! মুকুলও যাবেন।” পুরনো প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই গৌতমবাবু মনে করিয়ে দিয়েছেন, “মুকুল রায় ৩২ কোটি টাকা নগদ নিয়ে (বিধানসভা ভোটের আগে) বসেছিলেন। উপেন বিশ্বাস বাদে প্রায় সবাই সেই টাকার ভাগ নিয়েছেন। এ কথা বলায় মুকুল আমার নামে মানহানির মামলা করেছেন। আদালতে ১৯ বার আমি হাজিরা দিলেও মুকুল যাননি।”
মুকুলবাবু এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে গৌতমবাবুর অসুস্থতার প্রতি ইঙ্গিত করে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “পাগলা গারদ কোথায় আছে, গানটা মনে পড়ে গেল! প্রতিবার নির্বাচন আসে, আর প্রতিবারই এই নৃত্য দেখতে হয়! কেন অসুস্থ লোকটাকে টেনে আনে সিপিএম?”
শুধু গৌতমবাবুই নন, অন্য বিরোধীরাও মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে সমানে বিঁধেছেন। কলকাতায় এ দিন বিজেপি-র সহ-সভাপতি মুখতার আব্বাস নকভি কটাক্ষ করেছেন, “মমতাকে সারা দেশ বিদ্রোহের কন্যা বলে জানত। কোথাও কোনও অন্যায়, দুর্নীতি দেখলেই তিনি প্রতিবাদে সরব হতেন। অথচ ক্ষমতায় আসার মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি পরিণত হলেন দুর্নীতির রানিতে!” প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও প্রশ্ন তুলেছেন, “এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, সরকারি দলের জবাব কোথায়? কেমন যেন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘাবড়ে যাচ্ছেন!”
আর গৌতমবাবু বারেবারেই বিঁধেছেন মমতা-মুকুলকে। অভিযোগ করেছেন, “তৃণমূলের মন্ত্রী, এমনকী, মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের পিছনে সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সে করে সারদার টাকা বস্তায় ভরে মেদিনীপুর থেকে কলকাতা আসত। রাত ১টার সময় নিউ টাউনের রাস্তায় মমতা ফোন করে কুণাল ঘোষকে ডেকে পাঠাতেন। অত রাতে তো অপরাধীরা রাস্তায় থাকে!” ডেলোর বৈঠক প্রসঙ্গে দাবি করেছেন, “ওই বৈঠকে আরও কথা হয়েছে। সব কথা, ছবি সময়মতো প্রকাশ হবে!”
কৌশলে তৃণমূল নেতাদের মধ্যে বিভাজনের চেষ্টা চালিয়ে গৌতমবাবু বলেছেন, “সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সৌগত রায়, গোবিন্দ নস্কর, এঁরা এ ধরনের মানুষ নন।” পথে নামার হুঁশিয়ারি দিয়ে তাঁর মন্তব্য, “বামফ্রন্ট শেষ হয়ে গিয়েছে কি না, ১১ সেপ্টেম্বরের পরে কিছুটা আর বাকিটা পুজোর পর থেকে তৃণমূল বুঝতে পারবে!” গৌতমবাবুর কথায়, ১১ তারিখ থেকে তাঁদের কর্মী-সমর্থকেরা সারদা, রোজভ্যালি এবং এমপিএসের বিভিন্ন অফিস-বাড়িতে হানা দেবেন। কলকাতায় এমপিএসের ১৭টা বাড়ি আছে। সেগুলি বিক্রি করে মানুষকে টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হবে। তা না হলে রেললাইন, ঝুপড়ি, বস্তি থেকে মানুষ (যাঁরা মূলত অর্থলগ্নি সংস্থায় আমানত করেছেন) এনে সেই সব বাড়িতে ঢুকিয়ে দেবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন গৌতমবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy