বাবা-মায়ের সঙ্গে শ্বেতা।—নিজস্ব চিত্র।
ফাইট শ্বেতা, ফাইট!
প্রতি দিন মেয়েকে এ ভাবেই উত্সাহিত করত বাবা। আর মেয়েও লড়াইয়ের জলে সাঁতরে গিয়েছে একনাগাড়ে।
এও আর এক ‘কোনি’র গল্প। দারিদ্রের সঙ্গে প্রতি দিন লড়াই করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। যে গল্পের শেষে গরিব মুদি দোকানি বাবার একমাত্র মেয়ে হয়ে ওঠে আইএএস অফিসার।
মঙ্গলবার ইউপিএসসি-র ফল প্রকাশিত হয়েছে। সেই তালিকায় ১৯ নম্বরে রয়েছে শ্বেতা অগ্রবালের নাম। শ্বেতার বাড়ি হুগলির ভদ্রেশ্বরে। গত বছরে একই পরীক্ষা দিয়ে আইপিএস-এ সুযোগ পেয়েছিলেন শ্বেতা। এই মুহূর্তে তিনি হায়দরাবাদে ন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমিতে আইপিএস-এর ট্রেনিং নিচ্ছেন। দিন কয়েক আগেই জানতে পেরেছেন ২৯ বছরের শ্বেতা পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডার হিসাবে কাজ করবেন। তার মধ্যেই আইএএস হওয়ার নতুন এই খবর! লড়াইয়ের সেই জলেই খুশিতে ভাসছে গোটা অগ্রবাল পরিবার।
এ গল্পের ‘ক্ষিদ্দা’ আসলে সন্তোষ অগ্রবাল নামে এক মুদির দোকানি। হুগলির ধুঁকতে থাকা শিল্পাঞ্চলে তাঁর ছোট্ট একটা দোকান ছিল। ভদ্রেশ্বরের মতো জায়গায় ব্যবসা যেমন চলে আর কি! তাই, অভাবি সংসার। তবু, মেয়েকে কোনও দিন সে অভাব বুঝতে দেননি। টানাটানির মধ্যেও ছোটবেলা থেকে তার পড়াশোনার দিকে নজর রাখতেন বাবা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য মেয়েকে প্রথম থেকেই উত্সাহিত দিয়ে গিয়েছেন। মুদির দোকান একেবারেই চলছে না দেখে, শেষে ধার-দেনা করে ভদ্রেশ্বর গেটের কাছে একটি বাড়ি নির্মাণের লোহার দোকান খোলেন। কর্মচারী না এলে এখনও তিনি নিজেই লোহা কাঁধে নিয়ে ভ্যানে তুলে দেন।
নিজের লোহার দোকানে শ্বেতার বাবা সন্তোষ অগ্রবাল। বুধবার সকালে তাপস ঘোষের তোলা ছবি।
নিজে কোনও মতে ‘এগারো ক্লাস’ পর্যন্ত পড়েছেন। তার পর ‘বারো’য় গিয়ে আর পাশ করা হয়নি। কিন্তু, তা নিয়ে নিজের ভিতর কোনও সঙ্কোচ পুষে রাখেননি। হিন্দি টানে অবলীলায় বলে দেন, ‘‘আমি বারো ক্লাস ফেল। আসলে বাবার আমলেও দোকানটা খুব একটা ভাল চলত না।’’ আর স্ত্রী? ‘‘ও ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে।’’ কিন্তু, মেয়ে শ্বেতা প্রথম শ্রেণি থেকেই প্রথম হত। বরাবর নব্বই শতাংশের উপরে নম্বর পেয়ে এসেছে। আর বাবা-মায়ের মনে আশাটা আরও বেড়েছে, মেয়ে আইএএস হবে এক দিন।
দশম শ্রেণি পর্যন্ত চন্দনগরের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট, একাদশ-দ্বাদশে ব্যান্ডেলের অক্সিলিয়াম কনভেন্ট, তার পর সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে ইকনমিক্সে অনার্স— দৌড় যেন এখান থেকেই শুরু হল। এর পর মুম্বই থেকে ফিনান্সে এমবিএ করেন শ্বেতা। সেই কোর্স শেষ করে একটি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি। বছরখানেকের মধ্যেই ফের পুরনো ইচ্ছে ‘আইএএস’ হওয়ার লক্ষ্যে চাকরি ছেড়ে পড়াশোনা শুরু। নিজের মতো করে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কখনও কোনও কোচিং সেন্টার বা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার কথা ভাবতে পারেননি। কারণ আর্থিক সঙ্কট। তবে, দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনাটা চালিয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন
বাঙালির অধঃপতনের ইতিহাস চিরন্তন
ফলও পেয়েছেন। ২০১৩-য় ইউপিএসসি পরীক্ষা দিয়ে আইআরএস (ইন্ডিয়া রেভিনিউ সার্ভিস)-এ চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। কাস্টমস অ্যান্ড সেন্ট্রাল এক্সাইজ নার্কোটিক্স-এ যোগ দিয়েছিলেন। সে ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই আইপিএস-এ সুযোগ পেয়ে ট্রেনিং নিতে চলে গেলেন হায়দরাবাদ। এ বার সেই ট্রেনিং-এর মাঝেই আইএএস-এ সুযোগ পেলেন।
মেয়ের এই ধারাবাহিক সাফল্যে চোখে জল ধরে রাখতে পারছেন না সন্তোষবাবু।
কারণ মেয়েকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও তো প্রতি দিন নিজেকে বলে গিয়েছেন, ফাইট সন্তোষ, ফাইট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy