Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ভরবিকেলে রক্তপাত ভলিবলের মাঠে

যুবকের হাঁসুয়ার কোপে কিশোরী খুন বারাসতে

বিকেলে মাঠে ভলিবল খেলছেন জাতীয় স্তরের কিছু কিশোরীও তরুণী খেলোয়াড়।হঠাৎই ছুটে এসে মাঠে ঢুকে পড়ল বছর কুড়ির যুবক। চকিতে জামার ভিতর থেকে বার করল হাঁসুয়া। আস্ফালন করতে করতে তেড়ে গেল এক কিশোরী খেলোয়াড়ের দিকে।

সঙ্গীতা আইচ।

সঙ্গীতা আইচ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৪
Share: Save:

বিকেলে মাঠে ভলিবল খেলছেন জাতীয় স্তরের কিছু কিশোরীও তরুণী খেলোয়াড়। হঠাৎই ছুটে এসে মাঠে ঢুকে পড়ল বছর কুড়ির যুবক। চকিতে জামার ভিতর থেকে বার করল হাঁসুয়া। আস্ফালন করতে করতে তেড়ে গেল এক কিশোরী খেলোয়াড়ের দিকে। আতঙ্কিত কিশোরী বাঁচার আশায় ছুটে গিয়ে লুকোনোর চেষ্টা করল প্রশিক্ষকের পিছনে। আততায়ী তাড়া করে গিয়ে হাঁসুয়া দিয়ে কুপিয়ে খুন করল মেয়েটিকে। সকলের সামনেই। তার পরে মাঠে পড়ে থাকা একটা জার্সি দিয়ে নিজের গায়ে ছিটকে লাগা রক্ত আর হাঁসুয়াটি মুছে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেল ঘাতক।

হলে হতে পারত রুপোলি পর্দার চিত্রনাট্য। আসলে এটা কিন্তু রক্তাক্ত বাস্তব। শুক্রবার বিকেলে বারাসতের নতুনপুকুর অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে এ ভাবেই খুন হয়ে গেল বাংলা জুনিয়র ভলিবল দলের খেলোয়াড় সঙ্গীতা ওরফে টিনা আইচ (১৫)। তাকে খুনের অভিযোগে সুব্রত (রাজা) সিংহ নামে জাতীয় দলের এক ভলিবল খেলোয়াড়কে ধরতে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। সুব্রত শ্যামনগরের বাসিন্দা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, ব্যক্তিগত আক্রোশে রাজাই খুন করেছে টিনাকে।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সুব্রতের মা।

দিদির সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের ছুরিতে কিশোর রাজীব দাসের মৃত্যু, কামদুনিতে কলেজ থেকে ফেরার পথে ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন ছাড়াও নারী-নির্যাতন ও খুনের ঘটনায় বারে বারেই খবরে এসেছে বারাসত। এ দিনের ঘটনা ফের প্রমাণ করল, বারাসত রয়েছে বারাসতেই। তবে উত্তর ২৪ পরগনার এক পুলিশকর্তার দাবি, ‘‘বছর দুয়েক আগে বারাসত থানা ভাগ হওয়ার পর থেকে খুন বা নারী-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। এ দিনের ঘটনা নেহাতই ব্যক্তিগত আক্রোশে বলে মনে হচ্ছে। অভিযুক্তকে ধরতে তল্লাশি চলছে।’’

ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?

ওই মাঠে আজ, শনিবার জাতীয় স্তরের ভলিবল প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার কথা। তারই প্রস্তুতি হিসেবে মাঠে খেলছিল জুনিয়র দলের মেয়েরা। বিকেল ৪টে নাগাদ পাঁচিল ঘেরা মাঠের গেট দিয়ে হঠাৎ ঢোকে রাজা। সেই সময় চেয়ার নিয়ে মাঠের বাইরে বসে খেলোয়াড়দের তত্ত্বাবধান করছিলেন প্রশিক্ষক স্বপন দাস। তিনি বলেন, ‘‘রাজা সোজা মাঠে ঢুকে জামার ভিতর থেকে বড়সড় একটা হাঁসুয়া বার করে। তার পরে ‘এ দিকে আয়, এ দিকে আয়’ বলে টিনার দিকে তেড়ে যায়। আমি ওকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ও হাঁসুয়া নিয়ে পাগলের মতো করতে থাকে।’’

স্বপনবাবু জানান, রাজার ওই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে মেয়েরা ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। ত্রস্ত টিনা ছুটে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে প্রশিক্ষকের পিছনে। প্রশিক্ষককে ঠেলে সরিয়ে টিনাকে মারতে যায় রাজা। স্বপনবাবু বলেন, ‘‘আমি চেয়ার দিয়ে মারলাম ছেলেটাকে। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে টিনা।’’ মাঠে উপস্থিত অন্য এক কিশোরী খেলোয়াড় জানায়, টিনাকে পালাতে দেখে রাজা তাড়া করে। ছুটতে ছুটতে মাঠের মধ্যে নেটের কাছে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে। পরপর কোপ মারে টিনার কাঁধে, মাথায়।

পুলিশ জানায়, টিনা লুটিয়ে পড়ে সেখানেই। তার পরে মাঠে পড়ে থাকা একটি জার্সি দিয়ে রক্ত মুছে বাইরে বেরিয়ে যায় রাজা। সম্ভবত বাইরে মোটরবাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিল তার সঙ্গী। তার সঙ্গেই পালায় রাজা।

টিনাদের বাড়ি মাঠের পাশেই। তার কাকা গোপাল আইচের তেলেভাজার দোকান আছে সেখানে। গোপালবাবু বলেন, ‘‘চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে মাঠে ঢুকে দেখি, ছটফট করছে টিনা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাঠ। অন্য মেয়েরা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। কোনও মতে টিনাকে ভ্যানরিকশায় তুলে বারাসত হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, তত ক্ষণে মৃত্যু হয়েছে তার।’’

কেন খুন, সেটা স্পষ্ট হয়নি। তবে টিনার মায়ের বক্তব্য থেকে জানা গিয়েছে, ওই কিশোরীকে দীর্ঘদিন ধরেই বিরক্ত করত রাজা। বারাসত গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী টিনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তার মা-বাবা। কান্না থামছে না দাদা সুরজিতেরও। টিনার মা শুভ্রাদেবী বলেন, ‘‘খেলতে গিয়ে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মেয়েকে নানা ভাবে বিরক্ত করত রাজা। মেয়ে আপত্তি তোলায় ছেলেটা বাড়িতে ফোন করে ভয় দেখাত। ইদানীং খেলা ছেড়ে নানা দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়েছিল রাজা। আমরা কিছু দিন আগে বারাসত থানায় গিয়ে অভিযোগও করেছি। কিন্তু ও যে এমন কিছু করে ফেলতে পারে, ভাবতে পারিনি।’’

বারাসত থানায় অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও পুলিশ আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়নি কেন, উঠছে সেই প্রশ্ন। অভিযুক্তকে গ্রেফতারের দাবিতে রাত ৯টা নাগাদ কংগ্রেস-সিপিএম জোটের তরফে বারাসত থানা ঘেরাও করা হয়। মিনিট চল্লিশ পরে পুলিশের আশ্বাস পেয়ে ঘেরাও উঠে যায়।

কোথায় গেল রাজা?

শ্যামনগর কাউগাছির দক্ষিণ চণ্ডীতলায় রাজার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছেন তার মা রেখা সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ছেলে এমন করতেই পারে না।’’ মাঝখানে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও এ বার ফের মাধ্যমিক দিয়েছে বছর কুড়ির রাজা। প্রতিবেশীরা জানান, পাড়ায় কারও সঙ্গে তেমন মেলামেশা ছিল না ওই যুবকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE