চার বছরে অনুদান বেড়েছে ১০০ গুণ!
আয়কর দফতরে দাখিল করা তৃণমূলের হিসেব ঘেঁটে এমনই তথ্য পেয়েছেন সিবিআই গোয়েন্দারা। আনন্দবাজারেরও হাতে আসা সেই হিসেব বলছে, ২০১০-’১১ আর্থিক বছরে অনুদান খাতে তৃণমূলের আয় ছিল ১০ লক্ষ টাকা। এর পরের বছরে (২০১১-’১২) তা বেড়ে হয় ১৩ লক্ষ টাকা। ২০১২-’১৩ সালে অনুদানের পরিমাণ ছিল ৩৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু ২০১৩-’১৪ সালে ওই খাতে আয় এক লাফে বেড়ে হয়েছে সাড়ে নয় কোটি টাকা! হিসাবশাস্ত্রের সাধারণ নিয়ম বলে, কোনও খাতে আয় আচমকা এতটা বেড়ে গেলে একটা প্রশ্নের জায়গা তৈরি হয়। সেটা কোনও ব্যবসায়িক সংস্থার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, দলীয় তহবিলের ক্ষেত্রেও তেমন সত্য। তা ছাড়া, সারদা সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বছরেই কী ভাবে তৃণমূলের পাওয়া অনুদানের পরিমাণ এতটা বেড়ে গেল, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে বলেই সিবিআই গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি। আর সেই কারণেই তৃণমূল নেতৃত্বকে নোটিস পাঠিয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে চেয়েছে সিবিআই।
তৃণমূলের তরফে এই ক’বছরে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন দলের সদ্য-প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। নির্বাচন কমিশনকেও হিসেব জমা দিয়েছেন তিনিই। সেই হিসেবের সঙ্গে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট সংস্থা ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে’র তৈরি করা ব্যালান্স শিট জমা দিয়েছেন মুকুল। আয়কর দফতর ও নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া সেই হিসেবে তৃণমূলের ঠিকানা দেখানো হয়েছে ৩০বি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
তৃণমূলের হিসেব ঘিরে এই প্রশ্ন সম্পর্কে অবশ্য এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি মুকুল। ‘‘আমি এখন দলের কোনও পদে নেই। তাই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’ তবে হিসেবে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই বলেই ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সীও। সম্প্রতি তৃণমূল ভবনে ফোন করে সুব্রতর খোঁজ করার পরে সোমবার তাঁর নামেই নোটিস পাঠিয়েছে সিবিআই। দলীয় হিসেবে প্রশ্নের জায়গা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে সোমবার রাতে ফোন করা হলে প্রশ্ন পুরোপুরি না শুনেই ফোন নামিয়ে রাখেন তৃণমূলের নতুন সবর্ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। পরে আর ফোন ধরেননি।
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, শুধু অনুদান খাতে আদায় নয়, ছবি বিক্রি করে আয়ের অঙ্ক নিয়েও তাদের বেশ কিছু প্রশ্ন রয়েছে। পর পর বেশ কয়েক বছর মমতার ছবি বিক্রি করে দলীয় খাতে টাকা তোলার ঘোষণা প্রকাশ্যে করা হলেও অডিট রিপোর্টে ছবি বিক্রি বাবদ আয় দেখানো হয়েছে ২০১১-’১২ এবং ২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে। প্রথম বছরে এই খাতে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকা। দ্বিতীয় বছরে ২ কোটি ৫৩ লক্ষ। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে সাড়ে ৬ কোটি।
হিসাবশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞদের বক্তব্য, কেউ তাঁর নিজের আঁকা ছবি কোনও রাজনৈতিক দলকে বিক্রি করার জন্য দিতেই পারেন। সে বাবদ পাওয়া টাকা দলের হিসেবেও ঢুকতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে অডিট রিপোর্টের সঙ্গে একটি ‘অ্যানেক্সচার’ দেওয়া উচিত। তাতে ছবিগুলি কে দিলেন, কতগুলি ছবি দিলেন, সেগুলির কোনটা কী দামে বিক্রি হল, কে কিনলেন— ইত্যাদি তথ্য অডিটরের নোটে আসা উচিত ছিল। সারদা মামলার অন্যতম আবেদনকারী এবং পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অমিতাভ মজুমদারের কথায়, ‘‘যে কোনও অনুদান গ্রহণের ক্ষেত্রে দলের হিসেবে এই তথ্য থাকা উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তাই এই ছবি বিক্রির হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।’’
শুধু তাই নয়, ছবি বিক্রির টাকার একটি বড় অংশ কেন নগদে এসেছে— তা নিয়েও ধন্দ তৈরি হয়েছে। সিবিআইয়ের দাবি, অডিট রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ছবি বাবদ সাড়ে ছ’কোটি টাকা আয়ের মধ্যে মাত্র ১১ লক্ষ ৩১ হাজার টাকার ক্ষেত্রে ২৫ হাজার ১৮৩ টাকা ‘টিডিএস ডিমান্ড’ করা হয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, এর অর্থ, ওই ১১ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে বাকি সব টাকাই এসেছে নগদে। এত মোটা টাকার অঙ্ক সাধারণ ভাবে নগদে আসার কথা নয় বলেই মনে করছেন তাঁরা। তৃণমূলের দাখিল করা হিসাবপত্র খতিয়ে দেখার জন্য সিবিআই তদন্তকারীরা ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন দুঁদে অডিটরদের সঙ্গে। সংস্থার এক কর্তার দাবি, হিসেব দেখে চোখ কপালে উঠেছে হিসাবশাস্ত্রের ওই সব পোড় খাওয়া লোকেদের। সিবিআই-কে তাঁরা বলেছেন, কোনও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট যে এত কাঁচা হাতে হিসেব তৈরি করতে পারেন, তা বিশ্বাস করাই কঠিন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy