প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নীরব কেন? এত বড় একটা মারাত্মক অভিযোগ উঠল তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, সত্য-মিথ্যার যাচাই পরে হবে, তার আগে ছবিতে তো দেখা গেল তৃণমূলের তাবড় নেতারা গোছা গোছা নোট তুলে নিচ্ছেন হাতে! সত্যি হলে সত্যি, মিথ্যা হলে মিথ্যা, গর্জে উঠবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এক বারও বলবেন না, যদি এই অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হয়, তা হলে চূড়ান্ত শাস্তি দেবেন তিনি! অথবা, পরিচিত হুঙ্কারটা শোনা যাবে না, সবটা মিথ্যা, হতেই পারে না এই সব! এই কলঙ্ক লেপনের চেষ্টাকে বেআব্রু করে ছাড়বেন না তিনি? প্রত্যাশিত কোনও প্রতিক্রিয়ার পথেই হাঁটলেন না কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? উত্তরবঙ্গের জনসভা থেকে পরোক্ষে ‘কুত্সা’র অভিযোগ করে শুধু বুড়ি ছুঁয়ে যাবেন তিনি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি শোভে এই আচরণ?
তার কারণ, দ্বিধায় পড়েছেন তৃণমূল নেত্রী। যে সততার ভাবমূর্তিকে সামনে রেখে গত বিধানসভা ভোটে জিতে এসেছিল তাঁর দল, নারদ-কাণ্ড সেই ভাবমূর্তি বেআব্রু করে দিয়েছে আর এক ভোটের মুখে। দ্বিধাজর্জর মমতাকেই এ বার বেছে নিতে হবে, কোন পথ তিনি গ্রহণ করবেন। তিনি রাখবেন, নাকি তিনি মারবেন! রাখতেও তিনি, মারতেও তিনি, সুতরাং আগুপিছু ভেবেই তাঁকে স্থির করতে হবে, কী করতে চান তিনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিধার কারণগুলো কী হতে পারে?
১) তিনি নিজে সম্পূর্ণত নিশ্চিত হতে পারছেন না, নারদ-কাণ্ডে ওঠা অভিযোগের সারবত্তা আছে না নেই এই প্রশ্নে। নিজে আগ বাড়িয়ে তাই বেশি না বলে দলের নেতাদের দিয়ে অভিযোগ খণ্ডন করাতে চাইছেন। ভবিষ্যতে অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে, যাতে নিজের মুখ অন্তত খুব বেশি না পোড়ে।
২) এ যাবত্, সে তহলকা-কাণ্ডই হোক অথবা সিপিআই বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের ঘটনাই হোক, অভিযোগ ওঠা মাত্রই পদত্যাগ দাবি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিডিও অভিযোগ উঠলেই পদত্যাগের দাবি যদি যুক্তিযুক্ত হয়ে থাকে, তবে এ ক্ষেত্রে অন্যথা হবে কেন? অভিযোগ প্রমাণের আগে, অভিযোগ যে হেতু উঠেছে, জনসমক্ষে স্বচ্ছতার কারণেই পদত্যাগ করা উচিত— আজ মমতাকে এই যুক্তির বিপরীত পথে হাঁটতে হচ্ছে। মমতা দ্বিধান্বিত কি এই কারণেও?
৩) কিন্তু, অভিযোগ প্রমাণের আগে মমতা এই নেতাদের পদত্যাগ করতে বলছেন না কেন? কারণ, নিয়ন্ত্রণে নেই আর কিছুই। এত নেতাকে সরে যেতে বললে তাসের ঘর না হয়ে যায় দল, এই আশঙ্কা অতএব মমতাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখল। এগোলে দল ভাঙবে, পিছোলে ভাবমূর্তি, শাঁখের করাতে পা রেখেছেন মমতা।
৪) নারদ-কাণ্ড অতএব মমতার কাছে অন্য অর্থেও টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসছে। এর পর, আর কোনও দিন, অভিযোগ উঠলেই পদত্যাগ দাবি করার অমোঘ অস্ত্রটি ব্যবহার করতে পারবেন না এই বঙ্গের অগ্নিকন্যা। অভিযোগ যে ‘চক্রান্ত’ হতে পারে, ‘সাজানো’ হতে পারে— শাসকের এই যুক্তি মানতে হবে মমতাকে। অন্যথায় ইতিহাস তর্জনী তুলে তাঁর বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ তুলবে।
৫) মমতা অতএব যেটা করতে পারতেন, সেটা সব দিক দিয়েই গ্রহণযোগ্য হতে পারত। তিনি দলীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়ে জনসমক্ষে স্বচ্ছতার বার্তা দিতে পারতেন। তদন্তের রিপোর্টে যত ক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে অভিযুক্ত নেতারা দোষী, তত ক্ষণ তাঁরা স্বপদে থাকতে পারতেন। শ্যাম ও কূল দুই-ই রাখা সম্ভব হতো তা হলে। তাও করা সম্ভব হল না তাঁর পক্ষে।
সম্ভব কেন হল না, তার উত্তরটা মহাকাব্যে রয়েছে। অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশের শিক্ষাই পেয়েছিলেন, নিষ্ক্রমণের পন্থা জানা ছিল না তাঁর। অতএব, তিনি নীরব থাকবেন। এবং তাঁর দলের নেতাদের মুখে শোনা যাবে তত্কালীন শাসক সিপিএমের কণ্ঠস্বর। ‘মানুষ ভোটে রায় দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন, অভিযোগ সত্যি না মিথ্যা’— এই কথা গত কয়েক দশক ধরে শোনা গিয়েছে, শোনা যাচ্ছে আবার।
মমতা কি তা হলে এ বার এটা মানতেও প্রস্তুত, ৩৪ বছর ধরে মানুষ ভোটে রায় দিয়ে বুঝিয়েছে, সিপিএমের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা! ইতিহাসকে পাশে পাবেন তিনি?
আরও পড়ুন
গোপনে ঘুষের ছবি, অস্বস্তি শাসক দলের
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy