Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে পদ গিয়েছে, মন্ত্রীর ভরসা যায়নি

আলাপ হয়েছিল ২৪ বছর আগে। নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে রেজাউল করিম ওরফে বাপির কার্যত অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রতারণা-ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে আপ্ত সহায়কের পদ খোয়ানোর পরেও মদনবাবুর আস্থা হারাননি বাপি। মন্ত্রীর অনেক একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও বাপিই সামলাতেন।

সিবিআই অফিসে বাপি করিম। শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

সিবিআই অফিসে বাপি করিম। শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৪২
Share: Save:

আলাপ হয়েছিল ২৪ বছর আগে। নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে রেজাউল করিম ওরফে বাপির কার্যত অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র। তৃণমূল সূত্রের খবর, প্রতারণা-ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে আপ্ত সহায়কের পদ খোয়ানোর পরেও মদনবাবুর আস্থা হারাননি বাপি। মন্ত্রীর অনেক একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও বাপিই সামলাতেন।

সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে পরিবহণ মন্ত্রীর প্রাক্তন আপ্ত সহায়ক বাপির বাড়িতে বৃহস্পতিবার হানা দিয়েছিল সিবিআই। দিনভর তাঁকে জেরাও করেন গোয়েন্দারা। শুক্রবারও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তকারীদের সূত্রের খবর, সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে হানা দিয়ে এবং কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বাপি এবং এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। তার ভিত্তিতেই বাপিকে জেরা করা হয়েছে। জেরায় ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সারদার সম্পর্ক নিয়ে অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে সিবিআই।

প্রশ্ন উঠেছে, মোমিনপুরের একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান বাপি কী ভাবে এত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন?

তৃণমূল সূত্রের খবর, সত্তরের দশকে বাপির বাবা, টেলিকম ফ্যাক্টরির কর্মী খাজা বক্স মোমিনপুরে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯০ সালে তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেতা মদন মিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয় বাপির। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ১৯৯২ সালে পার্ক স্ট্রিটের একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষাকর্মীর চাকরিতে যোগ দেন বাপি। তৃণমূল সূত্রের খবর, স্কুলে যোগ দেওয়ার তিন বছরের মধ্যে বেহালা শীলপাড়ায় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল খোলেন বাপি। বছর দুয়েকের মধ্যে বালিগঞ্জ ও ভবানীপুরে আরও দু’টি স্কুল খোলেন।

তৃণমূলের একাংশই বলছে, নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে মদনবাবু ও বাপির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে। মদনবাবু তখন বিরোধী দলের সাধারণ নেতা হলেও কার্যত তাঁর আপ্ত সহায়কের দায়িত্ব ছিল বাপির উপরেই। বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয়ও বাপির সঙ্গে দিব্যি আলোচনা করতেন মদনবাবু। বাপির বিয়েতে তিনিই ছিলেন বরকর্তা। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, বছর খানেক আগে মদনবাবুর বড় ছেলের বিয়েতেও অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে নানা গুরুদায়িত্ব বাপিই সামলেছেন।

তৃণমূলের একাংশ বলছে, মদনবাবুর সঙ্গেই তৃণমূলে যোগ দেন বাপি। ২০০৫ সালে বাপির স্ত্রী জসমিন করিম তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে কলকাতা পুরসভার ভোটেও লড়েন। বাপি সরাসরি মদনবাবুর কাজের দায়িত্ব নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন ২০০৮ সালে। সে সময় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে বিধানসভা উপনির্বাচনে দাঁড়ান মদন মিত্র। সে সময় ভোটের কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল বাপির।

মোমিনপুর-একবালপুরের বাসিন্দারা বলছেন, এলাকায় কখনই সরাসরি রাজনীতি করতে দেখা যায়নি বাপিকে। বরং তাঁর ভাই বাবলু রাজনীতির ময়দানে পরিচিত মুখ। কিন্তু মন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী হওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। “অনেক বামপন্থী আত্মীয় বাপির হাত ধরেই তৃণমূলে ভিড়েছেন।”মন্তব্য বন্দর এলাকার এক তৃণমূল নেতার।

সিবিআই সূত্রের খবর, বাপির এই প্রভাব বুঝেছিল বিষ্ণুপুরও। ২০০৯ সালের পর থেকে বিধায়কের এই ছায়াসঙ্গীর হাত ধরে ছিল সারদাও। ২০১০ সাল থেকেই সারদার মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন বাপি। সপ্তাহে অন্তত এক বার তিনি যেতেনই। তদন্তে সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মিডল্যান্ড পার্কের অফিস থেকে বেরোনোর সময় একটি খাম দেখা যেত বাপির হাতে। কখনও কখনও বাপি নিজে না এসে, কোনও প্রতিনিধিকেও পাঠাতেন। সেই প্রতিনিধিও খাম হাতে বেরোতেন বলে সিবিআই জানতে পেরেছে। মিডল্যান্ড পার্কের অফিস থেকে খামে করে কী নিয়ে যেতেন বাপি এবং সেই খাম কার কার কাছে পৌঁছত, তা জানার চেষ্টায় গোয়েন্দারা।

২০১১ সালের রাজ্যে পালাবদলের পর মন্ত্রী হন মদন মিত্র। আপ্ত সহায়ক হিসেবে বেছে নেন বাপিকেই। তবে সে সময়ে পরিবহণ দফতরে মন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখা কর্মীরা জানাচ্ছেন, কার্যত বাপিই সে সময়ে মন্ত্রী হয়ে উঠেছিলেন। মন্ত্রীর ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ’ সবই সামলাতেন বাপি। এমনকী, মন্ত্রীর নানা গোপন বৈঠকে একমাত্র বাপিই উপস্থিত থাকতেন। আবার বাপির সূত্র ধরে অনেকে সে সময়ে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠও হয়ে ওঠেন। বাপির ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, এই সময় নিজের স্কুল ব্যবসা থেকে সরে আসেন বাপি। সেই দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন তাঁর স্ত্রী জসমিন। অভিযোগ, এই সময় থেকেই বাপির সঙ্গে এলাকার প্রোমোটার এবং ঠিকাদারদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

২০১২-এর শেষে বাপির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ধর্ষণের মামলা করেন এক মহিলা। পুলিশ সূত্রের খবর, গ্রেফতারি এড়াতে প্রথমে ফেরার হয়ে যান বাপি। পরে পুলিশকে এড়িয়ে সরাসরি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

মন্ত্রীর আপ্ত সহায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হতেই নড়েচড়ে বসেছিল প্রশাসন ও তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তৃণমূল সূত্রের খবর, বাপিকে আপ্ত-সহায়ক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মদনবাবুকে নির্দেশ দেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। মদনবাবুর ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছেন, বাপির বিরুদ্ধে সেই মামলাটি প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে পরে মিটমাট হয়ে যায়। এ সবের মধ্যেও কিন্তু মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কাজের ভার বাপির উপর থেকে সরেননি। মদন ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতা বলেন, “খাতায় কলমে আপ্ত সহায়ক পদ হারালেও সেই কাজটা বাপিই করতেন। বাপিকে সঙ্গে নিয়েই মদনবাবু সর্বত্র যেতেন। মহাকরণ বা পরিবহণ ভবনে বড় একটা না-এলেও বাপির নিয়মিত যাতায়াত ছিল মন্ত্রীর নেতাজি ইন্ডোরের অফিসে।”

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী হওয়ার ফলেই কি সারদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল বাপির? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সিবিআইও।

সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা জেনেছেন, মদনবাবু বিষ্ণুপুরের বিধায়ক থাকার সময় থেকেই বাপির সঙ্গে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মন্ত্রীর মাধ্যমে বিষ্ণুপুরের একটি মন্দির সংস্কারে প্রায় ১ কোটি টাকা সারদার কাছ থেকে ব্যবস্থা করেছিলেন বাপি। ওই মন্দিরের অনুষ্ঠানে বাপির সঙ্গে সুদীপ্তকেও দেখা গিয়েছিল বলে অভিযোগ। সিবিআই সূত্রের খবর, বাড়ি তল্লাশি করার সময় বাপির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-সহ নানা আর্থিক বিনিয়োগ ও লগ্নির নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। তাতে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি রয়েছে বলে অভিযোগ। যদিও এ দিন সিবিআই দফতরে ঢোকার আগে বাপি বলেন, “আমার সব সম্পত্তি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। বেআইনি সম্পত্তি নিয়ে যারা প্রচার করছে, তারাই প্রমাণ দিক।” তবে সুদীপ্তর সঙ্গে পরিচয়ের কথা স্বীকার করেছেন তিনি। এ দিন সন্ধ্যায় সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, “তিন বার সুদীপ্তর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দু’বার নেতাজি ইন্ডোরে, এক বার ওর অফিসে।” তবে সারদা যে অর্থলগ্নি সংস্থা, তা তিনি জানতেন না বলেই বাপি দাবি করেছেন।

এ দিন সংবাদমাধ্যমের সামনে সারদার সঙ্গে পরিবহণ মন্ত্রীর সম্পর্ক নিয়েও মুখ খুলেছেন বাপি। বলেছেন, “মদন মিত্র আমার নেতা, জননেতা। অনেকেই তাঁর সঙ্গে ঘোরে। তিনি কোনও অনুষ্ঠানে গেলে দোষ কোথায়! আমার এবং মদন মিত্রের বিরুদ্ধে সারদার টাকা নেওয়ার প্রমাণ পেলে যেন গ্রেফতার করা হয়।” তাঁর অভিযোগ, সিবিআই বিজেপির হয়ে কাজ করছে। এ রাজ্যে বিজেপি নেই বলেই সিবিআই অতি সক্রিয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE